সোমবার, ৭ মে, ২০১২

কবীর চৌধুরীর সঙ্গে আলাপ---- বেবী মওদুদ

( কবীর চৌধুরী (জন্ম. ৯/২/১৯২৩); ছবি: ফিরোজ আহমেদ)




[কবীর চৌধুরীর এই সাক্ষাৎকারটি ভিডিওতে গ্রহণ করা হলেও কিছু সম্পাদনা করা হয়েছে। ২১ ও ২২শে অক্টোবর ২০০৯ দুই দফায় সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করা হয়। সাক্ষাৎকারের ভিডিও মোট তিনটি অংশে পরিবেশিত হলো। বি. স.]


বেবী মওদুদ: প্রিয় পাঠক আমরা আজ এসেছি বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, শিল্প বোদ্ধা ও অনুবাদক হিসাবে যিনি আমাদের কাছে সর্বজন শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর কাছে। একজন বড় মাপের মানুষ হয়ে ওঠার পেছনে যে কতখানি পরিশ্রম দরকার, অভিজ্ঞতা ও চর্চা, সাধনা দরকার আমরা সেটা কবীর চৌধুরীর মধ্যে দেখেছি। বয়স হয়েছে তাঁর প্রায় ৮৮ বছর। ৯ ফেব্রুয়ারি ১৯২৩ সালে তার জন্ম হয়। এখনও এই বয়সে তিনি প্রতিদিন লেখার টেবিলে বসেন এবং বড় ধরনের কাজ করেন অনুবাদের এবং অন্যান্য লেখার। সামনের বই মেলায় তার বোধহয় ১২/১৩টি বই ছাপা হবে। সে বইগুলোর কাজও করছেন। আমরা আজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম এর পক্ষ থেকে তার বাসায় এসেছি। তার মুখ থেকে শুনবো তার কথা। তার জীবনের কথা শুনবো, তার শিক্ষা জীবনের কথা, শুনবো তার শৈশব-কৈশোরের কথা।


কবীর ভাই, আপনি কেমন আছেন? আপনার সময় কাটে কীভাবে?


কবীর চৌধুরী: লেখা পড়াতে আমার সময় খুব দ্রুত কাটে এবং আমার মাঝে মাঝে মনে হয় যে ১৮ ঘণ্টা দিন হলে ভাল হতো। আমি সকালে সাড়ে পাঁচটার দিকে উঠে পড়ি। মুখহাত ধুয়ে তারপর ছয়টার মধ্যে লিখতে বসি এবং সারাদিনে অন্তুত ৭/৮ ঘণ্টা লেখার কাজ করি। কিছু পড়ার কাজ করি। কাজেই সময় কাটা নিয়ে অনেকেরই বৃদ্ধ বয়সে যে অভিযোগ থাকে, সময় কাটে না, আমার সেটা নাই।


বেবী মওদুদ: আপনি তো বিভিন্ন সভায় যাচ্ছেন।


কবীর চৌধুরী: হ্যাঁ, সভায় যাচ্ছি। গতকাল একটা খুব তাৎপর্যপূর্ণ সভায় গিয়েছিলাম। বাংলার বাইরে থেকে ‘প্রতীচি’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়। প্রমথনাথ বিশীর মেয়ে এটা বের করেন। সেই পত্রিকার পাঁচ বছর পূর্তি উপলকে একটা সভা ছিল। সেই সভাতে ছিলাম, তার পরে সেখান থেকে উঠে বাংলা একাডেমিতে আর একটা সভা ছিল, সেখানে গিয়েছি।


বেবী মওদুদ: এখনও তো বই পড়েন। এর মধ্যে পছন্দসই কী কী বই পড়লেন?


কবীর চৌধুরী: আমি নিয়মিত এখনও পড়ি। একটা বই এখন পড়ছি, খুবই চমৎকার লাগছে। বইটির নাম ‘দি হোয়াইট টাইগার’। খুব কৌতূহলোদ্দীপক ব্যঙ্গাত্মক। তবে তার মধ্যে ভারতের দারিদ্র্যের চিত্রও খুব বাস্তবসম্মত ভাবে উঠে এসেছে। আরও পড়ছি তুরস্কের নোবেল বিজয়ী লেখক ওরহান পামুকের ‘স্নো’। অসামান্য একটি উপন্যাস। সেটা পড়া প্রায় শেষ করেছি এবং ঐ একই লেখকের একটি প্রবন্ধ গ্রন্থ আছে, নাম ‘আদার কালার্স’। আমি ‘আদার কালার্স’ এর বেশ কিছু লেখা বাংলায় অনুবাদ করেছি। সেটাও সামনের বই মেলায় আসবে। আর ‘স্নো’র বাংলা অনুবাদ ‘তুষার’ এখনও শেষ হয়নি, প্রায় ৪৫০ পৃষ্ঠার বই। এখনও ৪০ পৃষ্ঠার মত বাকি আছে। তাও হয়ে যাবে এবং সেটাও এই বই মেলায় আসবে। এই এখন আমার প্রধান কাজ এবং তার পাশাপাশি প্রবন্ধ লেখা তো হচ্ছেই। যেমন বঙ্গবন্ধুর হত্যার মাস সামনেই ১৫ই আগস্ট। তার উপরে লেখার জন্য অনুরোধ আসছে, লিখছি।


বেবী মওদুদ: আপনার শৈশব-কৈশোরের স্মৃতি নিশ্চয়ই মনে আছে কিছু কিছু। অনেকগুলো ভাইবোন ছিলেন আপনারা।

কবীর চৌধুরী: হ্যাঁ, অনেক কথাই মনে আছে। আমরা ঢাকায় বসবাস শুরু করি ১৯৩৬-এর দিকে। তার আগে ছোটবেলা কেটেছে কয়েকটি জায়গায়: পিরোজপুরে, মানিকগঞ্জ ইত্যাদি জায়গায়। পিরোজপুরে আমি প্রথম স্কুলে ভর্তি হই। তার আগে পর্যন্ত আমার পড়াশুনা বাসায় বাবার কাছে। স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হই। পিরোজপুরের কথা মনে আছে। আমরা বেশ বড় পরিবারের সদস্য ছিলাম। ভাই বোনদের নিয়ে অনেক গল্প করতাম। মুনীরের অনেক স্মৃতি খুব উজ্জ্বল হয়ে আমার মনে গাঁথা আছে।


বেবী মওদুদ: আপনাদের যে পারিবারিক বন্ধনটা ছিল, অনেক ভাইবোন ছিলেন। আপনার মা-বাবা সবাই মিলে একটা যে সম্পর্ক ছিল…।


কবীর চৌধুরী: আমাদের পারিবারিক সংহতি খুবই মধুর ছিল। আমরা এক সঙ্গে খাওয়াদাওয়া করতাম। বাবা বয়স হয়ে যাওয়ার পরে একটু আগে খেতেন। তখনও আমাদের খাওয়ার সময় তিনি টেবিলে এসে বসতেন এবং আমাদের সঙ্গে গল্প করতেন। আর মা তো ছিলেন এক অসম্ভব ধৈর্যশীলা স্নেহময়ী মানুষ। তুমি তো বোধহয় দেখেছো তাঁকে, আমার ঠিক খেয়াল নেই।


বেবী মওদুদ: হ্যাঁ, দেখেছি। আপনাদের বাসায় আমি গিয়েছি।


কবীর চৌধুরী: তিনি সকল ছেলেমেয়ের খাবার পরিবেশন করতেন খাওয়ার টেবিলে।


বেবী মওদুদ: আপনার সময় তো তারুণ্যের একটা ধর্ম ছিল। পড়াশুনাটাই মনে হয় আপনার প্রধান কাজ ছিল। পাঠ্যবইয়ের বাইরেও পড়াশুনার আগ্রহটি ওই সময় ছিল। তারপর তো লেখালেখিতে আসলেন। ঐ সময় আপনার বন্ধু বান্ধব কে কে ছিলেন?


কবীর চৌধুরী: আমার স্কুল এবং কলেজ জীবনে খুব ভাল বন্ধু দু’একজন ছিল। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজনই প্রয়াত। হিমাংশু দত্ত বলে একটা ছেলে ছিল। ঐ যে প্রথম দিকে ঢাকায় ফটোগ্রাফ স্টুডিও তৈরি করেছিল, মাই স্টুডিও নাম দিয়ে। পুরানা পল্টনের ওদিকে একটা গ্যারেজের মধ্যে কনভার্ট করে নিজেই ডেভলপ করতো, নিজেই ওয়াশ করতো। সেই ছেলেটি মারা গেছে। সে ছিল, আর ইউনিভার্সিটিতে উঠে যে সব বন্ধু-বান্ধব হয়, তাদের মধ্যেও অনেকেই বেঁচে নাই। স্যার এ. এফ রহমানের দুই ছেলে ছিল। একজন একটু উপরে পড়তো, কিন্তু আমার বন্ধু ছিল। আরো একজন ছিল আনোয়ার হোসেন খান নামে। এরা ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। তখন আবদুর রউফ নামে খুব প্রতিভাবান আর একটি ছেলে ছিল। ম্যাট্রিকুলেশনে বোধহয় ফার্স্ট হয়েছিল। সেও মারা গেছে। আমার খুব ঘনিষ্ঠ এবং ভাল বন্ধু ছিল। কলেজে ওঠার পরে আরো দু’ একজন বন্ধু-বান্ধব হয়। একটি বন্ধুত্বের স্মৃতি বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। এই অর্থে যে ও ছিল নেটিভ ক্রিশ্চান এবং সেই সময়, তোমার তো মনে থাকবে, রেল বিভাগে অনেক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান চাকুরি করতো। এই ছেলেটি ছিল অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পরিবারের ছেলে। পুরো নাম মনে নাই। ডাকনাম উইলি বলে আমরা ডাকতাম। তো ওর বাড়িতে ও আমাকে আমন্ত্রণ করেছে কয়েকবার। বেচারাম দেউড়ির গলিতে বাসা ছিল।


বেবী মওদুদ: ওই সময় তো অনেক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পরিবার ছিল…।


কবীর চৌধুরী: হ্যাঁ। তখন ওই আমার প্রথম অভিজ্ঞতা অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পরিবারের সঙ্গে। আমি সেখানে গিয়ে দেখলাম তার বোন ১৫/১৬ বছরের মেয়ে, ফ্রক পরে খোলা চুলে ঘোরাঘুরি করছে। ওই অভিজ্ঞতা আমার প্রথম। এর আগে দেখিনি।


বেবী মওদুদ: সাংস্কৃতিক জগতে বা সাহিত্য জগতে কোনো ভাল বন্ধু ছিল কি?


কবীর চৌধুরী: লেখালেখির বন্ধুদের চাইতে ক্রীড়ামোদী বন্ধুদের সাথে খুব বেশি ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। আমি যখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ি তখন আমার খেলার বেশ ইচ্ছাও ছিল। আমি সলিমুল্লাহ হলে থাকতাম। হলে ফুটবল টিমে খেলেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ে টিমে হকি খেলেছি। কাজেই খেলোয়াড়দের সঙ্গেই বেশি সখ্য হয়। লেখকদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় পরবর্তী সময়ে। যেমন কবি আবুল হোসেনের সঙ্গে বেশ হৃদ্যতা হয়। রশীদ করীমের সঙ্গে বন্ধুত্ব আছে। মোটামুটি শিল্পী-সাহিত্যিকদের মধ্যে তেমন ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব তখন কারো সঙ্গে গড়ে ওঠেনি।



বেবী মওদুদ: তো আপনি লেখালেখিতে কীভাবে এলেন?


কবীর চৌধুরী: লেখালেখিতে আসি আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের একটু আগে থেকে। তখন আমার নাটকের প্রতি বরাবরই খুব উৎসাহ ছিল এবং প্রথম দিকে আমার লেখা ছোটখাটো প্রবন্ধ। এ ছাড়া নাটক রূপান্তরের কাজে আমি প্রথম আসি।


বেবী মওদুদ: ইংরেজি নাটক থেকে আপনি বাংলায়…।


কবীর চৌধুরী: হ্যাঁ, এবং আমাকে অনেকে প্রশ্ন করে আপনার তো কোনো সৃজনশীল সাহিত্যকর্ম তেমন নেই। কথাটা সত্যি। আমার প্রবন্ধ আছে। কিন্তু যথার্থ সৃজনশীল সাহিত্যকর্ম নেই। তবে কিছুটা তার কাছাকাছি আছে রূপান্তরিত নাটকগুলোর মধ্যে।


বেবী মওদুদ: আপনি সাধারণত বাংলায় লেখালেখির চর্চা খালি প্রবন্ধেই করেছেন। আর ইংরেজীতে লিখেছেন এবং অনুবাদ করেছেন। বাংলায় এবং ইংরেজীতে যে কাজ করেন এতে কোনো সমস্যা হয় না?


কবীর চৌধুরী: না, আমি কোনো সমস্যা বোধ করি না। আমি ইংরেজী উপন্যাস, প্রবন্ধ, কবিতা ইত্যাদি বাংলায় অনুবাদ করি। বাংলা লেখাও ইংরেজীতে অনুবাদ করি। শওকত ওসমানের ‘ক্রীতদাসের হাসি’ শিল্পী সুলতানের উপরে একটা বই, সেলিনা হোসেনের উপন্যাস, শামসুর রাহমানের কবিতা, মুনীর চৌধুরীর নাটক এবং আরো অনেকের লেখা ইংরেজিতে অনুবাদ করেছি। আর ইংরেজী বই তো বাংলায় অনবরত অনুবাদ করে যাচ্ছি। আমার খুব বেশি অসুবিধা হয় না। অনেকে অসুবিধার সম্মুখীন হন বলে আমাকে বলেছেন। তার একটা কারণ হচ্ছে যে এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় অনুবাদ করতে গেলে শুধু দুই ভাষার জ্ঞান থাকলেই হবে না, দুই সংস্কৃতি সম্পর্কেও একটা জ্ঞান থাকতে হবে। কারণ সেই সংস্কৃতি তো ভাষাকে অনেকখানি চালিত করে। আমি অনুবাদ কাজ করার সময় মূল গ্রন্থটি যে সামাজিক পরিবেশ, সাহিত্যিক পরিবেশ, সাংস্কৃতিক পরিবেশে রচিত তা বুঝবার চেষ্টা করি এবং আমার পড়ালেখা মোটামুটি ব্যাপক থাকায় আমি সে কাজটা করতে পারি। তার ফলেই অনুবাদ ইংরেজী থেকে বাংলায় হোক বা বাংলা থেকে ইংরেজী হোক আমার কাছে তা তেমন সমস্যা হয়ে ওঠে না। বাংলা থেকে ইংরেজীর ব্যাপারে তো সামাজিক পরিবেশ তো জানাই, শুধু ভাষার প্রশ্ন। সেইখানে প্রতিটি ভাষার কিছু নিজস্ব ইডিয়াম আছে। আক্ষরিক অনুবাদ করলে কিছুতেই হবে না। যেহেতু মোটামুটি ইংরেজী এবং বাংলায় একটা কাজ চালাবার মতো জ্ঞান আমার আছে, সে হিসেবে আমি তেমন কোনো অসুবিধা বোধ করি না। তবে সময় দিতে হয়, ভাবতে হয়, পরিশ্রম করতে হয়।


বেবী মওদুদ: সাধারণত দেখা যায় যারা স্কুলে পড়ে বা ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেয় প্রায় সবাই ইংরেজীতে খারাপ করে।


কবীর চৌধুরী: সত্যি কথা।


বেবী মওদুদ: আপনি তো ইংরেজীতে ছোটবেলা থেকে নিশ্চয়ই খুব ভাল ছাত্র ছিলেন।


কবীর চৌধুরী: হ্যাঁ, আমি ছোটবেলা থেকে ইংরেজীতে ভাল ছাত্র ছিলাম। তার একটা কারণ হচ্ছে বাবা ইংরেজীতে খুব ভাল ছিলেন। উনি আলীগড়ে পড়াশুনা করেছেন। সাহেব অধ্যাপকদের কাছ থেকে। তিনি ইংরেজী এক্সপ্রেশন, শব্দচয়ন, রচনা রীতি খুব ভাল বুঝতেন এবং তিনি আমাদের হাতে কলমে পড়িয়েছেন। তোমাকে একটা মজার কথা বলি, কী ভাবে আমরা শিক্ষালাভ করেছি। আমাদের তখন ইংরেজীতে চিঠি লিখতে হতো। তুমি জানো সে যুগে শিক্ষিত সমাজে সেটারই প্রচলন ছিল। পারিবারিক চিঠিও ইংরেজীতে লিখতে হতো। আমরা বাবাকে যখন চিঠি লিখতাম ইংরেজীতে, তিনি সেই চিঠিটা ফেরত পাঠিয়ে দিতেন লাল গোল দাগ দিয়ে। দেখাতেন কোথায় কোথায় ভুল হয়েছে। তো এইভাবে আমরা শিখেছি এবং মোটামুটি ভালই ইংরেজী জ্ঞানলাভ করেছি এবং এটা পারিবারিক সূত্রে পরের প্রজন্মেও এসেছে, এই অর্থে যে আমার মেয়ে শাহীন ইংরেজীর অধ্যাপিকা এবং সেও খুব ভাল ইংরেজী জানে এবং এখন ইংরেজি শিক্ষার ব্যাপারে বহুমুখী কাজ করছে।


বেবী মওদুদ: আমাদের যে ছোট বেলায় ইংরেজী শেখানো হয়, ক্লাস ওয়ান থেকে তো ইংরেজীটা ওই বয়স থেকে কী শেখানো দরকার? না, আরো বড় হয়ে ইংরেজী যার যখন দরকার তখন পড়ালে ভালো হয় ?


কবীর চৌধুরী: এটা নিয়ে দ’ুটি মত আছে। কেউ কেউ মনে করে যে ছোট বেলা থেকে শেখানো ভালো। তারা তাড়াতাড়ি এগিয়ে যেতে পারবে। কিন্তু আমি মনে করি যে এটা অত্যাবশ্যক নয়। কারণ শিক্ষার ব্যাপারটা বহুলাংশে নির্ভর করে শিক্ষাদান পদ্ধতির উপরে এবং শিক্ষার উপকরণের উপরে। যদি ভাল উপকরণ সরবরাহ করা যায় এবং শিক্ষাদান পদ্ধতি যদি ভাল হয় তাহলে তিন/চার বছরে একটা ভাষা খুব ভালোভাবে শেখা যায়। তা নাহলে কেমন করে আমাদের ছেলেরা মস্কোতে গিয়ে রুশ ভাষা শেখে এবং সেই ভাষায় থিসিস লিখতে পারে।


বেবী মওদুদ: তো ঐ যে ছোট বেলা থেকে ইংরেজী শেখানো হয় ফলে বাংলাটাও ভাল শেখে না, ইংরেজীটাও শেখে না। আবার ধর্ম শিক্ষাও দিতে হয়। ঐ সময় তো প্রাথমিক শিক্ষাটা অন্তত বাংলায় হওয়া উচিৎ।


কবীর চৌধুরী: আমরা এই ব্যাপারটার উপর খুব গুরুত্ব দিই। আমাদের যে নতুন শিক্ষা নীতি ২০০৯ হয়েছে তাতে খুব স্পষ্টভাবে আমরা বলেছি যে, প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার মাধ্যম হবে মাতৃ ভাষা বাংলা। ইংরেজী ক্লাস থ্রি থেকে শেখানো যেতে পারে। কিন্তু কিছুতেই মাধ্যম হিসাবে নয়। একটা ভাষা হিসাবে তা শেখানো যেতে পারে। আর আমরা গুরুত্ব দিয়েছি যে ধর্ম শিক্ষা, আনুষ্ঠানিক ধর্ম শিক্ষা, প্রাথমিক পর্যায়ে থাকবে না। আনুষ্ঠানিক ধর্ম শিক্ষার বদলে দেয়া হবে, প্রাথমিক পর্যায়ে নৈতিকতা শিক্ষা দেয়া হবে, যা সব ধর্মের মানুষের জন্য সমান প্রযোজ্য।


বেবী মওদুদ: মানে নৈতিক শিক্ষাটার উপরে জোর দেওয়া হয়েছে?


কবীর চৌধুরী: হ্যাঁ নৈতিক শিক্ষার উপরে জোর দেওয়া হয়েছে এবং এটাও আমরা পরামর্শ দিয়েছি যে যখন পাঠ্যপুস্তুক ইত্যাদি লেখা হবে, ক্লাস রুমে শিক্ষাদান করা হবে, তখনই ওই নৈতিক শিক্ষা গল্পের ছলে যেন দেয়া হয়, কাহিনির মাধ্যমে যেন বলা হয়। এইভাবেই আমরা বলেছি।


বেবী মওদুদ: কবীর ভাই এখানে একটা প্রশ্ন করি। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে আপনি তো অনেক দিন ধরে অনুবাদ করছেন। সেই ধরেন বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে।


কবীর চৌধুরী: হ্যাঁ, উনিশ শ’ পঞ্চাশের দিক থেকে আমি অনুবাদ করছি।


বেবী মওদুদ: তবে ঐ সময়ের লেখকদের বই এবং এখনকার লেখদের বইয়ের মধ্যে পার্থক্যটা কী দেখছেন?


কবীর চৌধুরী: বাংলাদেশের কথা যদি বলতে হয়…।


বেবী মওদুদ: না, বাংলাদেশের কথা নয়, আপনি বিদেশের কথাই বলেন।


কবীর চৌধুরী: বিদেশের কথার মধ্যে আমি বলবো, এখনকার অনেক লেখকের লেখাতেই স্বৈরাচার বিরোধী বিষয়গুলো, মানবাধিকারের পক্ষের বিষয়গুলো, এবং স্বৈরশাসকদের অধীনে মুক্তিকামী মানুষ কীভাবে নির্যাতিত হয়েছে এগুলো খুব বেশি উঠে আসছে। যেমন, অতি সম্প্রতি যে নোবেল পুরস্কার পেলেন রুমানিয়ার লেখক, তার লেখাতেও চসেস্কুর আমলে মানুষ কী রকম নির্যাতিত হয়েছে তা উঠে এসেছে। স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে, জাতিগত বৈষম্যের বিরুদ্ধে যে সব অত্যাচার নির্যাতন চলেছে সেইসব বিষয়ে খুব ভালভাবে লেখকরা লিখছে।


বেবী মওদুদ: তো এই ধরনের বিষয়গুলো তো আগে ছিল না।


কবীর চৌধুরী: আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গদের উপর নির্যাতনের বিষয় নিয়ে কিছু উপন্যাস ছিল। বিশ্বের বিভিন্ন এলাকায় যে সব নির্যাতন চলছে স্বৈরশাসকদের হাতে, দক্ষিণ আফ্রিকায়, নাইজেরিয়ায়, আরো অনেক জায়গায় তার এত বস্তুনিষ্ঠ এবং শৈল্পিক ভাল লেখা, খুব বেশি আসতে পারেনি ।


বেবী মওদুদ: তো আমরা আশা করি যে, সামনের বইমেলায় আমরা খুব ভাল লেখা কিছু বই পাব। একুশের বইমেলা হয়, আপনি তো নিশ্চয়ই বই মেলায় যান। আপনি বই মেলাটাকে কীভাবে দেখেন।


কবীর চৌধুরী: আমি বই মেলাটাকে ভাল চোখেই দেখি, কেউ কেউ নিন্দা করে এর ব্যবসায়িক দিকটা দেখে। কিন্তু গ্রন্থ প্রকাশকদের দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে, এটার তো একটা ব্যবসায়িক দিক আছেই এবং এই বই মেলার জন্য প্রকাশকরাও অপেক্ষা করে থাকে। পাঠকরা অপেক্ষা করে থাকে। লেখকরাও তাদের বই নিয়ে আসার জন্য ব্যস্ত থাকেন। সেই দিক থেকে আমি বই মেলাটাকে ভালই মনে করি। শুধু আমার মনে হয়, যেটা করার চেষ্টা হচ্ছে, বই মেলার পরিচালক কর্তৃপক্ষকে দেখতে হবে যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী বা বাঙালী জাতীয়তাবাদের বিরোধী কিংবা ধর্মান্ধতার সপক্ষে বই কতজন লিখছেন এবং স্টলে তা কী হারে দেখা যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে একটা ব্যবস্থা নেয়ার কথা ভাবতে হবে।



বেবী মওদুদ: বই মেলা নিয়ে আমার আর একটা প্রশ্ন আপনার কাছে। আপনিতো এক সময় বাংলা একাডেমীর প্রধান ছিলেন এবং এখন সভাপতি। বাংলা একাডেমী মুলতঃ বই মেলাটা নিয়ে খুব বেশী উৎসাহী। বই মেলা নিয়েই যেন তারা সারা বছর কাজ করে, এটা কেন? তাদেরতো অন্যান্য কাজও করা উচিত।


কবীর চৌধুরী: হ্যাঁ বই মেলাটাতে বাংলা একাডেমী অবশ্যই উৎসাহী। তবে বাংলা একাডেমীর যে কাজগুলো আবশ্যিকভাবে করা দরকার, অর্থাৎ গবেষণামূলক কাজ এবং অনুবাদের কাজ এবং উন্নতমানের পাঠ্য পুস্তুকের কাজ এটা বন্ধ হয় নি। কিন্তু এর মধ্যে আশানুরূপ গতি বেগ সঞ্চারিত হয়নি। তার একটা কারণ হচ্ছে অর্থের অপ্রতুলতা। একাডেমী ঠিক ঠিক অর্থ বরাদ্দ সরকারের কাছ থেকে পাচ্ছে না। তোমাকে একটা খবর দিই আমরা অতি সম্প্রতি ঠিক করেছি, সপ্তাহখানেকের মধ্যে অর্থ মন্ত্রীর সাথে বসবো এবং আমরা আমাদের সমস্যার কথাগুলো বলে তার কাছ থেকে বাংলা একাডেমীর জন্য একটা উপযুক্ত অর্থ বরাদ্দ পাওয়ার অনুরোধ জানাবো।


বেবী মওদুদ: প্রধান মন্ত্রী গত বই মেলায় বলেছিলেন যে গবেষণার জন্য অর্থ বরাদ্দ দিবেন।

কবীর চৌধুরী: প্রধান মন্ত্রী, আমার যতটুক মনে পড়ে, গবেষণা আর আমাদের সৃষ্টিশীল গ্রন্থের ইংরেজী অনুবাদের কথা বলেছিলেন। তো আমরা এ দু’টো কাজ বাংলা একাডেমী থেকে করবার চেষ্টা করছি।



বেবী মওদুদ: আপনিতো বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক ছিলেন, শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের সচিবও ছিলেন। তো আপনি যখন বাংলা একাডেমীতে মহাপরিচালক ছিলেন তখন বাংলা একাডেমী কি আজকের মত এতখানি নিয়ন্ত্রিত ছিল মন্ত্রনালয়ের দ্বারা । এখন একটা গবেষণার বই প্রকাশের অনুমতির জন্যও নাকি মন্ত্রনালয়ে যেতে হয়।


কবীর চৌধুরী: তুমি একটা খুব সংগত প্রশ্ন তুলেছ। বাংলা একাডেমী তখন সরকারী নিয়ম নীতির আওতায় থাকলেও তার বেশ কিছু স্বাধীনতা ছিল, তারা নিজেদের ইচ্ছেমতো কিছু প্রকল্প তৈরি করতে পারতো এবং আর্থিক সাহায্যও যতটুক সরকার দিতে পারে মোটামুটি আমরা পেয়েছি একসময়। কিন্তু এখন সরকারি নিয়ন্ত্রন অনেক বেড়ে গেছে। এটা বাংলা একাডেমীর মতো একটা স্বায়ত্তস্বাশিত প্রতিষ্ঠানের জন্য আকাক্সিক্ষত নয়। এ বিষয়ে আমরা ঠিক এখনই কাজে লেগে আছি, বাংলা একাডেমী এ্যাক্টকে পরিমার্জিত করার জন্য, এবং আমাদের কাজ অনেকখানি শেষ হয়ে এসেছে। বাংলা একাডেমীর যারা প্রাক্তন পরিচালক ছিলেন, যাদের প্রশাসনিক অভিজ্ঞতাও আছে এই রকম দুই একজনকে আমরা আমাদের এই কাজে পেয়েছি এবং আমরা সপ্তাহখানেকের মধ্যেই পরিমার্জিত বাংলা একাডেমী এ্যাক্ট সরকারের কাছে দিব। আমাদের খুবই আশা যে সরকার তাতে খুব বেশী কাট ছাঁট করবেন না।


বেবী মওদুদ: হ্যা সেটাই আমাদের কাছে অবাক লাগে বাংলা একাডেমীতে থেকে যে বই বের হবে সেখানে তা গবেষণার কাজ হবে সেটার জন্যও নাকি মন্ত্রনালয় থেকে অনুমতি নিতে হবে তা কেন ? যেহেতু কার্যনির্বাহী পরিষদই তো অনুমোদন দিতে পারে।


কবীর চৌধুরী: বাংলা একাডেমী একটা স্বয়ত্ত শাসিত প্রতিষ্ঠান। আমরা পরিমার্জিত যে এ্যাক্ট অনুমোদনের জন্য সরকারের কাছে পাঠাচ্ছি তাতে আমরা এইসব জিনিসগুলোর উপর গরুত্ব দিচ্ছি।


বেবী মওদুদ: তো, রাজনীতির দিকেও তো আপনি আগ্রহী ছিলেন।


কবীর চৌধুর: রাজনীতির দিকে আমি বামপন্থী তথা সাম্যবাদী আদর্শের প্রতি আকৃষ্ট হই। তাও বহুলাংশে ঘটে সাহিত্যের মধ্য দিয়ে। ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মাদার’ পড়ে ভীষণভাবে উজ্জীবিত হই এবং তার পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে নাৎসীদের বিরুদ্ধে ওই সমাজতান্ত্রিক শক্তি যেভাবে লড়াই করেছিল তার মধ্যে দিয়ে সমাজতান্ত্রিক শক্তি রাশিয়ার বিশেষ অনুরাগী হয়ে উঠি আমি। কিন্তু পরবর্তী সময় তাদের স্খলন দেখে খুবই মন খারাপ হয়।


বেবী মওদুদ: আপনিতো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দেখেছেন।


কবীর চৌধুরী: হ্যাঁ।


বেবী মওদুদ: তারপরে ভারতভাগও দেখেছেন, বাংলাভাগও দেখেছেন, আপনি দাঙ্গা হতেও দেখেছেন। তখনকার কোন স্মৃতি আপনাকে আজও নাড়া দেয়!


কবীর চৌধুরী: দাঙ্গার স্মৃতি খুবই নাড়া দেয়। তখনও পাকিস্তুান হয়নি। সেই সময়ও দাঙ্গা হয়েছে। চল্লিশের দশকের শেষ দিকে আমরা ঢাকায় অনেক দাঙ্গা দেখেছি এবং একটা অদ্ভুত জিনিস তখন লক্ষ করেছি যে কেন দাঙ্গা বাঁধে এবং কেন হঠাৎ থেমে যায়, এ রহস্য যেন বোঝা যেতনা। যার ফলে পরবর্তী সময়ে আমার বিশ্লেষণের মাধ্যমে আমার একটা বদ্ধমূল ধারণা হয়েছে যে সাম্প্রদায়িক ইস্যু ছাড়াও দাঙ্গার পেছনে কিছু স্বার্থান্বেষী মহলের হাত ছিল। জমি দখল, লুটপাট, ব্যবসা অধিকার করে নেয়া—এই সব কারণেই দাঙ্গা ঘটতো। কারণ হঠাৎই আবার দাঙ্গাটা বন্ধ হয়ে যেত।


বেবী মওদুদ: গবেষকদের বইতে আমরা দেখি বা জানি যে দাঙ্গায় শাসক গোষ্ঠিরও একটা হাত ছিল।


কবীর চৌধুরী: হ্যাঁ, ছিল বিশেষ করে বৃটিশ শাসনের আমলে এখানে দাঙ্গা-হাঙ্গামা হলে তাদের অনুকুলেই যেতো।


বেবী মওদুদ: কবীর ভাই, আপনি ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে লেখাপড়া করেছেন ইংরেজিতে অনুবাদ খুব ভাল করেন, আপনি কি খুব ভাল ছাত্র ছিলেন ইংরেজিতে ?


কবীর চৌধুরী: মোটামুটি ভাল ছাত্রই ছিলাম বলা যেতে পারে। আমার ইংরেজির প্রতি আকর্ষণ অবশ্য আমার বাবার কারণেই প্রথম হয়। তিনি আলীগড়ে পড়াশুনা করেছিলেন। ইংরেজির কয়েকজন খুব ভালো অধ্যাপকও ছিল তাঁর। চমৎকার ইংরেজি জানতেন আমার বাবা। তিনি আরবী, ফারসী এসবও জানতেন খুব ভাল। আচকান পায়জামা পরতেন সারা জীবন। তার উৎসাহ উদ্দীপনায় আমরা ইংরেজির প্রতি আকৃষ্ট হই এবং আমি ভাল ছাত্র ছিলাম। এটা আমি নিজেও বলবো, কারণ ইংরেজি অনার্সে আমি ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হই। সে বছর মাত্র একজনই ফার্স্ট ক্লাস পায়। আর এম.এ তেও আমি ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হই। যদিও তখন পাঁচ জন ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছিল। তখন একশোর মধ্যে ষাট পেলেই ফার্স্ট ক্লাস দেয়া হত। আমি কয়েকটি পেপারে ৬৫, ৬৬, ৬৭ পর্যন্তু নাম্বার পেয়েছি। সাধারণত এভারেজে ৬০ পেলেই ফার্স্ট ক্লাস হত, কিন্তু আমার ক্ষেত্রে এভারেজ করতে হয়নি। আমার প্রতি পেপারেই ৬০ এর উপরে নম্বর ছিল। আমি শুনেছে যে এর আগে একমাত্র বুদ্ধদেব বসুই আমার চেয়ে বেশী নম্বর পেয়েছিলেন।


বেবী মওদুদ: তো আপনিতো জানেন যে আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা ইংরেজিতে সব সময়ই খারাপ করে, ফেল করে। বেশীরভাগ ফেল করে এস.এস.সি পরীক্ষায়। ইংরেজিটাকে খুব ভয় পায় বলা চলে, আসলে কারণটা কি ?


কবীর চৌধুরী: আমার মনে হয় প্রধান কারণ হচ্ছে ইংরেজি শিক্ষাদানের ব্যবস্থা খুব দুর্বল। ইংরেজি শিক্ষাদানের মধ্যে প্রধানত শিক্ষক এবং শিক্ষার উপকরণ এইতো, এবং এই দু’টো দিক থেকে ইংরেজি শিক্ষার ক্ষেত্রে আমরা খুব উদাসীন।


বেবী মওদুদ: আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় যে দুর্বলতা আছে আপনাদের সময়ে সেটা কেমন ছিল?


কবীর চৌধুরী: এত দুর্বল ছিল না আমাদের সময়ে। এখনতো প্রচুর পিএইচডি শিক্ষক আছে। গ্রাম অঞ্চলে নেই, শহরে আছে। কিন্তু শহরের ছেলেরাও যে খুব ভাল ইংরেজি জানে তা নয়। তারা কিছু কিছু বুলি জানে, কিছু কিছু কলোক্যাল এক্সপ্রেশন তারা জানে। কিন্তু খুব সুন্দর বা ভাল, আকর্ষণিয় ইংরেজি তারা বলতে পারে না। এজন্য ভালো শিক্ষকের পাশাপাশি ভালো উপকরণ তৈরি করতে হবে। তুমি জানো কিনা জানি না, আমার মেয়ে শাহীন, তুমি তাকে চেনো। ও একটেল এবং ডেইলি স্টার পত্রিকার সঙ্গে মিলে সমস্ত দেশে ইংরেজি শিক্ষাদানের জন্য “ইংলিশ ইন স্কুল” নামে একটা প্রকল্প চালাচ্ছে। সেখানে ঐ খবরের কাগজের মাধ্যমে এটা করার চেষ্টা চলছে।


বেবী মওদুদ: তো আমাদের যে শিক্ষা ব্যবস্থা আছে সেখানে বাচ্চাদের উপরে এতো চাপ ছিল না। ইংরেজি শেখানোর ক্ষেত্রে এখন কিন্তু প্রচন্ড চাপ দেখা যায়। তার পরও খুব ভাল ইংরেজি জানা ছাত্র পাওয়া খুব কঠিন।


কবীর চৌধুরী: আমাদের শিক্ষা ক্ষেত্রে যে নানা রকম বৈষম্য এবং দুর্বলতা আছে, এগুলো কি করে দূর করা যায় সে সম্পর্কে ২০০৯ সালের শিক্ষা নীতিতে কিছু সুপারিশ মালা আছে।


বেবী মওদুদ: তো আর একটা কথা। বাংলাতে যে তারা খুব ভাল তাও কিন্তু নয়। শুদ্ধ বাংলা বানান তারা লিখতে পারে না। অনেক বি.এ পাস করা ছেলে মেয়েও পারে না, কারণটা কী? এদেরকে কী ভাল শিক্ষা দেওয়া হয় না ? না কি এখন ভালো শিক্ষক নাই।
কবীর চৌধুরী: এসব দুর্বলতা কিছুটা তো আছেই। এখন পড়ার অভ্যাস কম। ইন্টারনেট ও টেলিভিশনের সামনে ছাত্ররা খুব বেশী সময় থাকে। যারা গ্রহণ করতে পারছে তারা ভাল করছে কিন্তু সাধারণভাবে এর ফল খুব ভাল হচ্ছে না। পড়ার প্রতি আগ্রহটা কমে যাচ্ছে।


কবীর চৌধুরী: তো, আমার আর একটি বিষয় জানতে ইচ্ছে করে যে, শিক্ষার সঙ্গে সাধনা, চর্চা বা সৃজনশীলতার সম্পর্কটা কেমন ।


কবীর চৌধুরী: আমার মনে হয় খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকা উচিৎ। কিন্তু বাস্তুবে সব সময়ে থাকে না। তো এটাকে করতে হবে। আমি বলবো প্রাথমিক পর্যায়ের কথা। সে-শিক্ষাকে আনন্দদায়কও করতে হবে। এটা খুব দরকার ছাত্র যদি প্রথম থেকেই শিক্ষাকে ভয় করতে শেখে তাহলে তার শিক্ষা বাধাগ্রস্থ হবেই। তো আমরা যে ২০০৯ শিক্ষা নীতির কথা বলেছি, তাতে আমরা কিছু কথা বলেছি সুশিক্ষার ব্যাপারে।


বেবী মওদুদ: আপনিতো বিংশ শতাব্দির মানুষ। একবিংশ শতাব্দিতে এসেও আপনার জীবন আচরণ, জীবনযাপন, লেখা পড়া সবকিছুই চলছে আগের মতই। পার্থক্যটা কোথায়, কিছু টের পান?



কবীর চৌধুরী: নেতিবাচক দিক থেকে পার্থক্য হচ্ছে যে শহরের অবস্থা যন্ত্রনাদায়ক। নয়েজ পলিউশন, এয়ার পলিউশন। সব কিছু খুব কষ্টদায়ক। এটা হচ্ছে নেতিবাচক। তবে ইতিবাচক যে কিছু নেই তা নয়। যেমন আগে তথ্যের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হতো বা কষ্ট করে খুঁজতে হতো। যেমন, এই যে রুমানিয়ার লেখক হ্যাটা মুলার নোবেল প্রাইজ পেলেন, সঙ্গে সঙ্গে আমরা তার কতগুলো বই আছে, বইয়ের মূল বিষয়বস্তু কী, এসব তথ্য পাচ্ছি। এটা একটা ইতিবাচক দিক। আর যোগাযোগ হচ্ছে অন্যান্য লেখকদের সঙ্গেও । যাদের আমরা সমমনা মনে করি, তিনি বিলেতেই থাকুন কিংবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই থাকুন পত্র-পত্রিকা ও ফোনের মাধ্যমে, ই-মেইলের মাধ্যমে, আমরা তাদের সঙ্গে সহজেই যোগাযোগ রাখতে পারি। এটা একটা সাংস্কৃতিক ঐক্যও সৃষ্টি করছে। যারা প্রগতিশীল চিন্তার অধিকারী তারা সহজেই একে অন্যের খবর রাখতে পারছেন।


বেবী মওদুদ: কিন্তু জীবন আচারণে আপনি কোন সমস্যায় পড়ছেন কি ?


কবীর চৌধুরী: জীবন আচারণে আমি খুব বেশী পার্থক্য দেখি না। মেয়েদের ক্ষেত্রে কিছু লক্ষ করা যায় পোশাক আশাকের ক্ষেত্রে। সেটা নেতিবাচক নয়। আমি সেটা ইতিবাচকই মনে করি। আজকাল আমাদের তরুণীরা কেন, মাঝবয়সী মেয়েদেরও জিন্স পরে রাস্তায় চলা ফেরা করতে দেখি। শাড়ী পরাটা কিছু কমে যাচ্ছে।


বেবী মওদুদ: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনতো শাড়ি পরা মেয়ে খুবই কম দেখা যায়।


কবীর চৌধুরী: খুবই কম। প্রায় দেখাই যায় না একদিকে শাড়ী পরা মেয়ে কমে যাচ্ছে আর অন্যদিকে হিজাব পরা মেয়ের সংখ্যা বাড়ছে। এটা একটা বৈপরীত্ব।


বেবী মওদুদ: কেউ কেউ আবার সালোয়ার কামিজও পরে, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে শাড়ি পরাটা দেখতে ভাল লাগতো।


কবীর চৌধুরী: খুবই ভাল লাগতো এবং শাড়ি তো বাংলার পোশাক। তবে এখন এটা সর্বভারতীয় পোশাক। ভারতের সব নামী দামী অভিনেত্রীকে দেখবে শাড়ী পরছে।


বেবী মওদুদ: পাকিস্তুানেও পরে তারপরে নেপালেও পরে।


কবীর চৌধুরী: শাড়ি একটা খুব রুচিসম্মত সুন্দর জিনিশ। সেটা আমাদের এখানে কমে যাওয়াটা খুব ভাল চোখে আমি দেখি না।


বেবী মওদুদ: কবীর ভাই আপনিতো একজন শিক্ষাবিদ হিসাবে বঙ্গবন্ধু সরকারের শিক্ষাসচিব পদ পেয়েছিলেন। আপনি কত দিন ছিলেন সেখানে?


কবীর চৌধুরী: আমি শিক্ষা সচিব হিসাবে বোধহয় বছর খানেকের মত ছিলাম।


বেবী মওদুদ: এবং আপনি সেখান থেকে ছেড়ে চলে আসেন।


কবীর চৌধুরী: হ্যা, আমি সেখান থেকে ওই পদ ছেড়ে চলে আসি। আমি যখন ছেড়ে চলে আসতে চাইলাম, বঙ্গবন্ধু খুশি হননি। উনি বললেন যে, আপনি থাকেন আরো কিছু দিন। দেখেন। যখন আমি আমার অসুবিধার কথাগুলো বললাম, তখন তিনি আর একটা প্রস্তাব দিলেন। তাতে বোঝা যায় যে তিনি আমাকে কতটা ভালবাসতেন এবং আমার উপর কতটা বিশ্বাস রাখতেন। তিনি আমাকে বললেন যে ঠিক আছে, শিক্ষা সচিব হিসাবে যদি আপনি থাকতে না চান, তো আপনার কোন রকমের পদবী থাকবে না, এ্যাটাচড টু দি প্রাইম মিনিস্টার—এই ভাবে একজন সচিবের পদমর্যাদায় থাকবেন। আপনাকে আমি যে সব কাজ দেব দায়িত্ব দেব, আপনি সেগুলো দেখবেন। আমি দেখলাম এতো আরো বিপদের কথা। তো আমি অনেক অনুরোধ করলাম যে আপনি আমাকে ছেড়ে দেন। আর একটা ব্যাপারও ছিল তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন পূর্ণকালীন ফুল প্রফেসরের পদ খালি ছিল। এখন তো ফুল প্রফেসারের পদকে তেমন কিছু গণ্য করা হয় না। তখন একজন ফুল প্রফেসারের খুব মর্যাদা ছিল। আমরা যখন ছাত্র ছিলাম অনেক নামী দামী অধ্যাপক তখন রিডার হিসাবেই অবসর নিতেন। রিডার মানে আজকের দিনের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর। বঙ্গবন্ধুকে আমি আমার অসুবিধার কথা বললে তিনি জানতে চান কি অসুবিধা। যাই হোক, তোমারও হয়তো সেই প্রশ্নই থাকবে যে অসুবিধা কোথায় ছিল।


বেবী মওদুদ: হ্যাঁ। আপনি কি সমস্যাগুলো দেখেছিলেন ? আমরা যে আমলাতান্ত্রিক সমস্যাগুলো দেখি বা শুনি তাই কি ?


কবীর চৌধুরী: হ্যাঁ, আমি তার কথাই বলছি। যেমন কোন একটা বিশেষ কাজ আমি করতে চাইছি কিন্তু সেই নথি আরো অনেক জায়গায় যাবে এবং সব চাইতে বড় একটা অসুবিধা ছিল অর্থ পাওয়ার সমস্যা। যেমন, আমার একটা প্রধান ইচ্ছা ছিল, শিক্ষা সচিব হিসাবে, সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যে বৈষম্য, গুনগতমানের তারতম্য কমিয়ে আনা। এই কাজটি করার জন্য আমার নেতৃত্বে একটি কমিটিও গঠিত হয়। সে কমিটির নাম ছিল ‘নাইন মেম্বারস’ কমিটি’ অর্থাৎ নয় সদস্যের কমিটি। তখন আমরা কিছু সুপারিশ প্রণয়ন করি যাতে করে সরকারি কলেজ-বেসরকারি কলেজের ফারাকটা কমে আসতে পারে। তো, তার জন্য অর্থ একটা প্রধান প্রয়োজনীয় বিষয় ছিল। তখন আমাদের অর্থমন্ত্রী ছিলেন তাজউদ্দিন সাহেব। আমাকে তিনি চিনতেন এবং খুব ভালো জানতেন। আমি তাজউদ্দিন সাহেবের সঙ্গে দেখা করে তাঁকে বললাম। তিনি আমাকে খোলাখুলি বললেন, কবীর সাহেব, আমি আপনার কথা বুঝি কিন্তু আমাদের অর্থের সংগতির কথাটা ভাবতে হবে। একটা নতুন দেশ, আমরা নানা সমস্যার মধ্যে আছি। আপনি যা চাইছেন সে পরিমাণ অর্থতো দেওয়া যাবে না। তো যখন আমি দেখলাম যে আমার স্বপ্ন ও পরিকল্পনা অনুযায়ী আমি কাজ করতে পারছি না, তখন আমি সরে আসি।


বেবী মওদুদ: কবীর ভাই, আপনাদের সময়তো ডা. কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন হয়েছিল। নীতি মালাও প্রস্তত হয়েছিল এবং ঘোষিত হয়েছিল। ওটার বাস্তবায়ন তখন হলো না কেন? ওটা হলেতো আপনারা অনেক দুর এগুতে পারতেন ।


কবীর চৌধুরী: হ্যা, অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারতাম। কারণ কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা নীতির মধ্যে আমাদের সংবিধানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ অনেক কথা ছিল। কিন্তু সেটা কেন এগিয়ে যেতে পারল না?


বেবী মওদুদ: ওটাতো ’৭৩/ ’৭৪ সালে হবে বোধহয়।


কবীর চৌধুরী: তার পরেই তো ক্ষমতার রদ বদল হয়ে গেল। ওটা এক রকম কোল্ড স্টোরেজে চলে গেল, কুদরাত-ই-খুদা কমিশনের সুপারিশগুলি।


বেবী মওদুদ: ওটা থাকলে আমরা মনে হয় অনেকটা এগুতে পারতাম।


কবীর চৌধুরী: হ্যা, নি:সন্দেহে।


বেবী মওদুদ: তো এখন যে শিক্ষা নীতিমালা বেশ দ্রুত ঘোষণা করলেন আপনারা । আপনারা কি ওটার সঙ্গে কিছুটা সংগতি রেখেছেন বলে মনে করেন।


কবীর চৌধুরী: আমরা কুদরত-ই-খুদা কমিশনের যে শিক্ষা নীতি ছিল তার মৌলিক প্রগতিশীল সবগুলি দিক ঠিক রেখেছি। যেমন ধর্ম নিরপেক্ষতার বিষয়টি, যেমন বৈষম্য দূর করার জন্য শিক্ষাকে কাজে লাগানো। কারিগরি এবং বিজ্ঞান শিক্ষার উপরে গুরুত্ব দেওয়া। এগুলো কুদরত-ই-খুদা কমিশনে ছিল এবং আমাদের এই শিক্ষা নীতির মধ্যেও আছে। আমরা বিশেষভাবে জোর দিয়েছি বৈষম্য দূর করার উপর। এবং এটা প্রধান্য পেয়েছে প্রাথমিক পর্যায়ে। সে জন্যই আমরা বার বার একমুখী শিক্ষার কথা বলেছি। দু:খের বিষয় এই যে কোন কোন মহল থেকে ইচ্ছাকৃত ভাবে বিকৃত কথা ছড়ানো হচ্ছে এবং আমাদের রিপোর্টকে নিয়েও হয়তো একটা কিছু গোলমাল কোথাও হয়েছে। কারণ কোন কোন কাগজে আমি দেখেছি বলা হয়েছে সব ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থাতেই কতকগুলি কোর সাবজেক্ট থাকবে। কিন্তু সব ধরণের শিক্ষা তো না। প্রাইমারী পর্যায়ে এক ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থাই থাকবে। এই জিনিশটাকে একটু তালগোল পাকিয়ে ফেলা হয়েছে।


বেবী মওদুদ: সরকারি বেসরকারি সবখানে একই রকম থাকবে ?


কবীর চৌধুরী: হ্যাঁ, একই রকম হতে হবে। তার একটা অর্থ হচ্ছে যে, এখন যেমন ইংরেজী মাধ্যম স্কুল আছে সেটা থাকবে না। কারণ আমরাতো বলছি যে শিক্ষার মাধ্যম বাংলা হতেই হবে প্রাইমারী পর্যায়ে। মাদ্রাসায় যে আরবীর গুরুত্ব আছে সেটা তারা দিতে পারে, কিন্তু আমাদের এই কোর সাবজেক্টগুলো পড়িয়ে তার পরে।


বেবী মওদুদ: প্রাইমারীতে এটা আপনারা বাধ্যতামূলক করবেন?


কবীর চৌধুরী: হ্যাঁ। এটার উপরে আমরা জোর দিয়েছি। কিন্তু মিডিয়াতে এটা অন্যভাবে চলে আসছে। তবে এই প্রসঙ্গে আমি বলবো যে, এখনও তো নীতিটা গ্রীহিত হয়নি, চুড়ান্ত হয়নি। মতামত এখনও আসছে। ভিন্ন মত যেগুলো আসছে আমরা সেগুলোও বিবেচনা করবো।


বেবী মওদুদ: পত্রিকায় দেখলাম যে নারী নেত্রীরা বলেছেন, নারী শিক্ষা বলে আলাদা একটা চ্যাপ্টার আছে। তারা বলছেন যে নারী শিক্ষা আলাদা হবে কেন।


কবীর চৌধুরী: নারী শিক্ষা আলাদা একটা চ্যাপ্টার করা হয়েছে কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে নারীরা আলাদা ভাবে শিক্ষিত হবেন। স্কুল কলেজে নারীরা একই রকম শিক্ষা পাবে। কিন্তু নারী শিক্ষার আলাদা একটা চ্যাপ্টার করার অর্থ হচ্ছে তাকে একটু বেশী গুরুত্ব দেয়া। আমরা জানি যে, সংবিধানে যাই বলা হোক না কেন কিংবা আমরা মানবাধিকার সংস্থা থেকে যাই বলি না কেন সত্যিকার অর্থেই নারীরা ডিসক্রিমিনেশনের শিকার হয়। তো সেটা রোধ করার জন্য একটা আলাদা চ্যাপ্টার করে নারীশিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়েছি।


বেবী মওদুদ: তাহলে আপনারা বলছেন যে, কিন্ডারগার্ডেন স্কুলগুলি ও মাদ্রাসা শিক্ষানীতি আওতায় আসবে।


কবীর চৌধুরী: তারা শিক্ষা নীতির আওতায় আসবে এবং তাদেরকে সেটা মানতে হবে। মানতে হওয়ার ব্যাপারে আমরা একটা ভাল সুপারিশ করেছি। সেটা যদি গ্রীহিত হয় তবে আমরা অনেক এগিয়ে যাব। আমরা একটা এডুকেশন ‘ল’ বা আইন করার কথা বলেছি। এটা বিভিন্ন দেশে আছে। থাইল্যান্ডে আছে, আরো কয়েকটি দেশে আছে। এডুকেশন ‘ল’ বলে যদি একটি আইন থাকে এবং সেই আইনের ধারা যদি স্পষ্ট হয়, যা লংঘন করলে শাস্তি দেয়া যাবে। তাহলে অনেক কিছু কার্যকর করতে পারবো।


বেবী মওদুদ: তো আপনি কতখানি আশাবাদী যে এই নীতিমালা বাস্তবায়ন হবে?


কবীর চৌধুরী: আমি আশাবাদী এই বছরের শেষ নাগাদ আমরা কিছু কিছু বাস্তবায়নে যাব। আমি আশাবাদী দ’ুটি কারণে। এক হচ্ছে আমাদের শিক্ষা মন্ত্রী এ ব্যাপারে খুবই উৎসাহী। নুরুল ইসলাম নাহিদ, তিনি প্রগতিশীল রাজনীতি করেছেন সারাজীবন। তিনি আছেন আর তা ছাড়া আমাদের বর্তমান সরকার, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যে সরকার, সে সরকারও চাইবে, আমার বিশ্বাস আমাদের এই নীতিমালা বাস্তবায়িত হোক।


বেবী মওদুদ: তো কবীর ভাই, আমার আর একটা বিষয় জানতে ইচ্ছে করছে যে, আপনি তো পৃথিবীর অনেক দেশে গিয়েছেন। কোন দেশের শিল্প সাহিত্য সমৃদ্ধ বলে মনে হয়েছে এবং কেন মনে হয়েছে?


কবীর চৌধুরী: একসময় সেই দেশ ছিল সোবিয়েত ইউনিয়ন এবং মস্কো। কারণ যখন আমি ’৭০এর প্রথম দিকে মস্কোতে যাই ’৭২-’৭৩ সালে বেশ কয়েকবার অর্থাৎ সোভিয়েত ইউনিয়নের পালাবদল না হওয়া পর্যন্তু। পরে তাদের আগেকার যে সব নীতিমালা ছিল তা পরিবর্তিত হয় একটু স্বৈরাচারের ধাঁচে, পাশ্চাত্য মিশ্রণের নানান কথা বলে। একটা আদর্শবাদ আমাকে অনুপ্রাণিত করেছিল একসময় এবং তার প্রতিফলন আমি মস্কোতে দেখেছি। কতবার সেখানে গিয়েছি। সেইজন্য ঐ দেশটাকে খুব আদর্শ একটা দেশ বলে মনে হতো। কয়েকটা কথা বলি, বইপত্র এত সস্তায়, এত সুন্দর বই পাওয়া যেত কল্পনা করা যায় না এবং অজস্র অনুবাদ। শুধু যে তাদের কমিউনিস্ট সাহিত্য বইয়ের দোকানে আসতো তা নয়। পাশ্চাত্যের অনেক ইংরেজী সাহিত্য আমি সেখানে পেয়েছি এবং অনেক অল্প দামে, অবিশ্বাস্য অল্প দামে। রাষ্ট্রীয় সাবসিডি ছিল, সেই কারণে। তুমিতো জান, প্রগতি প্রকাশনার কথা এবং সেসব বাংলায় অনুবাদ করার জন্য কত গুণি লোক সেখানে ছিল। দ্বিজেন শর্মা ছিলেন, ভারতের অনেকে ছিলেন। আর যে কারণে তখন দেশটাকে ভালবাসতাম, সেখানে নিরাপত্তা ছিল। আমার মেয়ে মস্কো রেডিওতে কাজ করেছে একসময়। রাত্র ১২/১টার সময় সে একা বাড়ী ফিরে এসেছে। যেটা পরম বেদনার কথা তা এই যে, এখন সেই নিরাপত্তা সেখানে নেই। মস্কো, আমি শুনেছি, এখন একটা সন্ত্রাসের নগরীতে পরিণত হয়েছে। ছিনতাই, মারামারি অহরহ ঘটছে। তারা আগের অবস্থা ধরে রাখতে পারেনি। নিজেদের দুর্বলতাও ছিল, প্রশাসনের দুর্বলতাও ছিল। আর বাইরের বাকী সব দুনিয়াতো চেয়েছিল ওটাকে ধ্বংস করতে। এই দু’টো মিলিয়ে এই অবস্থা ঘটেছে।


বেবী মওদুদ: বর্তমান শতাব্দীকে বলা হয় যান্ত্রিক সভ্যতা বা বিজ্ঞান প্রযুক্তির শ্রেষ্ঠ সময়, বলা হয় এখন কম্পিউটার সর্বত্র, এসে গেছে। তাই এ সভ্যতাকে শ্রেষ্ঠ বলা যায়। নাকি মানবিক দিক দিয়ে আমরা এই সময়টাকে শ্রেষ্ঠ সময় বলবো ? কোন দিকটা আপনি মনে করেন।


কবীর চৌধুরী: বিজ্ঞানের অগ্রগতির দিক থেকে এই যুগটা অনেক আকর্ষনীয় এবং উপকারী। মানবিকদিক থেকে বরং তার উল্টো। কারণ এই শতাব্দিতে এসে গুয়েতমালা বন্দিশালার মতো কান্ড দেখতে হচ্ছে। একি আমরা কখনো ভেবেছিলাম ? তারপর কেউ কেউ তালেবানদের পক্ষে কথা বলেন, আমার সঙ্গেও যুক্তি-তর্ক করেন যে কেন তারা তো ইসলামকে অনেক উপরে তুলে আনছে। কিন্তু সন্ত্রাস এবং নৃশংসতার মাধ্যমে কোন ভাল কাজ হতে পারে না। তালেবান শব্দটাতো এখন সমার্থক হয়ে গেছে মৌলবাদী জঙ্গিদের সঙ্গে।


বেবী মওদুদ: তো কবীর ভাই, আমার আর একটা প্রশ্ন। আমি নিজেও অনেক অনেক সময় চিন্তুাভাবনা করেছি এবং অনেককে জিজ্ঞেসও করেছি, আমরা যাদের বুদ্ধিজীবি বলি, সমাজে কারা হলেন বুদ্ধিজীবী? আপনার মতে বুদ্ধিজীবির সংজ্ঞাটা কী হবে?


কবীর চৌধুরী: এটা একটা বিতর্কমূলক ব্যাপার। সংজ্ঞা দিতে গেলে তবে সাধারণভাবে আমরা যেমন বুঝি।


বেবী মওদুদ: আমরা যখন বার্ট্রান্ড রাসেলের নাম শুনি, রুশোর নাম শুনি—এদের কথা যখন শুনি তো সেই দিক দিয়ে বিবেচনা করলে আপনার কাছে কি মনে হয়।


কবীর চৌধুরী: সাধারণভাবে বুদ্ধিজীবী বলতে আমরা মনে করি, যারা লেখা পড়ার সঙ্গে যুক্ত। যারা জ্ঞান চর্চার সঙ্গে যুক্ত। অধ্যাপক, বড় মানের লেখক—এদেরকে আমরা বুদ্ধিজীবি বলি। আবার শব্দটার অন্যরকম ব্যাখ্যাও করা যায়, যারা জীবনধারণ করেন বুদ্ধি বিক্রী করে। তবে সেটা সে অর্থেও কিছুটা সত্য। লেখক তো লেখা বিক্রি করেন, অধ্যাপক তার জ্ঞান বিতরণ করে জীবনধারন করেন। তবে ক্ল্যাসিকাল অর্থে বুদ্ধিজীবি যাদের বলি সেই রকম বুদ্ধিজীবি আমাদের দেশে খুব বেশী নেই। তুমি একটু আগে যাদের কথা বললে রুশো, রাসেল, ভলতেয়ার।


বেবী মওদুদ: মানে যিনি বুদ্ধিতে অনেক বড় মাপের হবেন এবং সমাজ, মানুষ ও দেশকে একটা দিক-নির্দেশনা দেবেন ভাল-মন্দ কথাও বলবেন। এটা তিনি উপদেশ আকারে বলতে পারেন, বা তিনি একটা অভিভাবকত্বের দাবি নিয়ে বলতে পারেন।


কবীর চৌধুরী: নিশ্চয়ই। আমাদের এখানে ঠিক সেই রকম কিছু গড়ে ওঠেনি। আমরা কয়েকজনের মধ্যে তার অঙ্কুর দেখেছি। তাদের কথা বলতে পারি। আহমেদ শরীফ ছিলেন, এখন অধ্যাপক সালাহ্ উদ্দিন আছেন, ইতিহাসবিদ, সরদার ফজলুল করিম আছেন, অজয় রায় আছেন ফিজিক্স-এর ।


বেবী মওদুদ: এরপরে আমার আর একটা বিষয় জানার আছে যে, আপনি তো ১৯৭১ সালে বাংলা একাডেমিতে মহাপরিচালক ছিলেন। ঐ সময় ৭১এর মুক্তি যুদ্ধের সময় ঢাকা শহরের অবস্থা কি ছিল তাতো আমরা সবাই জানি। ঐ সময় বাংলা একাডেমির প্রধান হিসাবে আপনার উপর কি কোন চাপ ছিল? ঐ সময় তো পাকিস্তানি সরকার কুবুদ্ধি নিয়ে চেষ্টা করেছিল এখানকার কবি সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবিদের একত্রিত করতে ।


কবীর চৌধুরী: আমি তেমন কোন রকম চাপের মুখে ছিলাম না। আমার পক্ষে কাজ করা অত্যন্তু উদ্দীপনাময় হয় কয়েকটা বিশেষ কারণে। ঠিক স্বাধীনতা অর্জনের পরপর একটা প্রচণ্ড প্রাণ আবেগ ছিল। আমরা অনেকগুলো কাজ সেই সময় করি নিজেদের উদ্যোগে। সরকারের কোন নির্দেশ ছিল না। আমার নেতৃত্বেই আমরা কতগুলো কাজে হাত দেই, যেমন পররাষ্ট্রমন্ত্রনালয় যে চুক্তিগুলো করবে তার বাংলায় একটা ফরম্যাট হতে পারে। দ্বিভাষিক ইংরেজি এবং বাংলায় পরিভাষা তৈরির একটা বড় প্রকল্প আমরা হাতে নিই।


বেবী মওদুদ: কিছু কাজ কি হয়েছে ?


কবীর চৌধুরী: হ্যাঁ, কিছু কাজ হয়েছে। তোমার মনে আছে বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে সহযোগিতায় গোলাপি রংয়ের কতগুলো ছোট ছোট চটি বই তখন বের হয়েছিল। সেই প্রকল্পকে এখন আমরা আবার নতুন করে চালু করার চেষ্টা করছি, বৃহদাকারে।


বেবী মওদুদ: কবীর ভাই আমার জানান ইচ্ছা ছিল ঐ সময় ৭১সালে পাকিস্তুান সরকার, বুদ্ধিজীবি, কবি সাহিত্যিকদের দিয়ে তাদের সমর্থনে একটা পেপারে তাদের সবার স্বাক্ষর নিয়ে বিবৃতি দেওয়ার একটা চেষ্টা করেছিল, তো আমরা যতদুর জানি সুফিয়া কামাল এবং আপনি তাতে স্বাক্ষর করেন নাই। অনেকেই করেছিল তো ঐ ধরনের কোন চাপ আপনাকে বা সুফিয়া কামালকে দিয়েছিল বলে আপনার মনে আছে ?


কবীর চৌধুরী: আমরা তো একটা বড় বিবৃতি তৈরি করে ছিলাম যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই, নৃশংসতা যারা করেছে রাজাকার-আলবদরদের বিচার চাই এবং একটা খসড়া বিবৃতির মতো করে আমরা বাংলা একাডেমির সামনে টেবিল পেতে একটা বিরাট ভলিউমের বড় খাতা রাখি। আমার দু:খ হয় যে, সেগুলির আর কোন হদিস পরে আর পাইনি। সেখানে মনে হয় দুই তিন দিনের মধ্যে লক্ষাধিক লোকের সই নেয়া হয়েছে যে, আমরা বিচার চাই, বিচার চাই। তো সেই সময়ের প্রাণাবেগ তা ধরে রাখা যায়নি। সেটা স্বাভাবিকও। পরবর্তী সময়ে তা স্তিমিত হয়ে আসে। সরকারি সমর্থনও তখন পাওয়া যায়নি। তবে সরকারের সঙ্গে বাংলা একাডেমির সম্পর্কটা কী? আমরাতো একটা স্বায়ত্ত শাসিত প্রতিষ্ঠান। সরকার আমাদের সাহায্য সহযোগিতা দেবেন। এইখানে একটা টানাপোড়নের ব্যাপার আছে। তো এখন আমরা বাংলা একাডেমির এ্যাক্ট সংস্কারের কাজে ব্যস্ত রয়েছি। সপ্তাহখানেকের মধ্যেই আমাদের নুতন প্রস্তাবিত এ্যাক্ট মন্ত্রনালয়ে যাবে। এটাতে আমরা স্বেচ্ছাচারিতা নয়, স্বায়ত্তশাসনের উপর জোর দিয়েছি। আমাদের প্রয়োজনীয় স্বাধীনতা না দিলে বাংলা একাডেমির কাছ থেকে আক্সক্ষাখিত ফল পাওয়া যাবে না।


বেবী মওদুদ: তো কবীর ভাই আপনিতো যথেষ্ট অনুবাদ করেছেন। কত হবে মনে আছে ?


কবীর চৌধুরী: আমার অনুদিত বই ষাট, সত্তুরটা তো হবেই।


বেবী মওদুদ: সব মিলিয়ে কত বই হবে আপনার ?


কবীর চৌধুরী: আমার সব মিলিয়ে এখন প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা প্রায় দু’শ কিছু কম বা বেশী হতে পারে। এবারকার এই বইমেলায় ১২/১৩ টি বই প্রকাশ পাবে। তার মধ্যে অনুবাদ থাকবে, মৌলিক প্রবন্ধ গ্রন্থও থাকবে। ইংরেজি বা বাংলা দু’ভাষাতেই।


বেবী মওদুদ: অনুবাদ সাহিত্যকেও তো আমরা সাহিত্য হিসাবে গণ্য করতে পারি। এই অনুবাদ সাহিত্য করে আপনার কি অভিজ্ঞতা? আপনি কি মনে করেন এটা পাঠকদের কাছে খুব গুরুত্ব পূর্ণ সাহিত্য?


কবীর চৌধুরী: হ্যাঁ আমি মনে করি পাঠকদের জন্য এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য কর্ম। কারণটা তুমি সহজেই বুঝতে পারবে। আমাদের অনেকের পক্ষেইতো খুব বেশী ভাষা শেখা সম্ভব হয় না। বিশ্বের অনেক সেরা সাহিত্য যদি বাংলায় অনূদিত না হয় তাহলে তো আমরা তা থেকে বঞ্চিত হবো। এইখানে আমার একটা ক্ষোভ আছে অবশ্য। ক্ষোভটা হলো যে আমরা তো বেশির ভাগ সময় মূল ভাষা থেকে অনুবাদ করি না। ইংরেজীর ক্ষেত্রে যা করি। কিন্তু রুশ ফরাশি জার্মান দক্ষিণ আফ্রিকার ভাষা, এই সব ক্ষেত্রে কিংবা ল্যাটিন আমেরিকার সাহিত্য, এইসব ক্ষেত্রে তো আমরা ইংরেজী অনুবাদ থেকে অনুবাদ করি। মূল থেকে করি না। তার মানে হচ্ছে অনুবাদের অনুবাদ। এটা খুব সন্তোষজনক নয়। অপারগ হয়ে করতে হয়। এটা নিরসনের একটা ব্যবস্থা করা দরকার। আমাদের বিদেশি ভাষা ইনস্টিটিউট আছে বটে কিন্তু তার কাজ বা আউটপুট নানা কারণেই অত্যন্ত সীমাবদ্ধ। খুব বড় করে যদি আমরা বিদেশী ভাষার একটা ইনস্টিটিউট গড়ে তুলতে পারি এবং সেখানে যদি বিভিন্ন ভাষা যারা পড়তে পারেন, বুঝতে পারেন, এই রকম লোক তৈরি করতে পারি, তখন আমাদের এই অনুবাদের অনুবাদ সেটার হাত থেকে আমরা মুক্ত হতে পারবো।


বেবী মওদুদ: তো কবীর ভাই, আর একটা বিষয় জিজ্ঞেস করি আমাদের দেশের সাহিত্যে এবং পত্র-পত্রিকায় বর্তমানে যে বাংলা চর্চা করি অর্থাৎ যে বাংলাটা এখন চলছে বা পত্র-পত্রিকাতে আপনি দেখেন সেটা কেমন ? এটা কতখানি শুদ্ধ মনে হয় আপনার? পড়ে কি মনে হয় ? ইংরেজী পত্রিকাগুলো বা বাংলা পত্রিকাগুলো কি আন্তর্জাতিক মানের ?


কবীর চৌধুরী: এর রূপটা হচ্ছে মিশ্র। কিছু ভাল বাংলা হচ্ছে না এটাও বলা যাবে না এবং খুব বেশী অশুদ্ধ হচ্ছে তাও বলা যাবে না। এখানে ব্যাকরণ জ্ঞান ভাষার জ্ঞান বানান জ্ঞান এগুলোর একটা বড় ভূমিকা আছে। তো বাংলা একাডেমিতে আমরা একটি প্রকল্প নিয়েছি ভারতের সঙ্গে। তাদের অভিজ্ঞতা নিয়ে হবে। শ্রী পবিত্র সরকারের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। তুমি কাগজে দেখেছো, আমরা একটি ব্যাকরণের প্রকল্প নিয়েছি। বাংলা একাডেমির উদ্যোগে হবে।


বেবী মওদুদ: এটা কি কলকাতার বাংলা একাডেমি আর এখানকার বাংলা একাডেমি ?


কবীর চৌধুরী: না। ওদের কাছ থেকে দু’একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে নিয়ে এই প্রকল্প। কিন্তু প্রতিষ্ঠান হিসাবে যুক্ত হবে না।


বেবী মওদুদ: মানে, কাজটা আমাদের বাংলা একাডেমী করবে ?


কবীর চৌধুরী: হ্যাঁ।


বেবী মওদুদ: তো এটা বাস্তবায়িত কত দিন লাগবে?


কবীর চৌধুরী: এটা মোটে শুরু হয়েছে। আমি আশা করছি এটা হলে পরে আমাদের লেখালেখির মধ্যে যে একটা অবাঞ্ছিত মিশ্রণ ঘটে যায় একটা স্ট্যান্ডার্ডরাইজড কিছু হয় না, সেটা অনেকটা দুর হবে। কারণ ভাষার মেরুদন্ড হচ্ছে ব্যাকরণ।


বেবী মওদুদ: অবশ্যই। তো কবীর ভাই আর একটা বিষয় আপনাকে জিজ্ঞেস করি, আপনার সম্পর্কে আলোচনা হয় তো মানুষের মধ্যে। সমাজের মধ্যে একটা ভ্রান্তি আছে। এখানে কেউ কেউ আছে যে অন্যের পুরোনো বই নিজের নামে ছেপে দায় । এটাও আমি দেখি। কেউ কেউ অন্যের অনুবাদ নিজের নামে ছাপিয়ে দেয়, হয়তো মনে করে যে কেউতো পড়ে নাই। সেই রকম বইয়ের ফ্ল্যাপও আপনি লিখে দিয়েছেন। হয়তো আপনার অজান্তেই সেটা হতে পারে। এর ভিতর জুলফিকার নিউটন নামে একটি ছেলে কাজটি করেছিল এবং সে নিজেও এখন অনুতপ্ত হয়ে নিজেই বলে বেড়ায়। কিন্তু সব বইতো সবার পক্ষে পড়া সম্ভব না। তো আপনার কাছে কেউ পান্ডুলিপি নিয়ে এসেছিল কি?।


কবীর চৌধুরী: হ্যাঁ আমার কাছে মাঝে মাঝে অনেকে পা-ুলিপি নিয়ে আসে। তো সেগুলো খুব পরিচিত বা বন্ধুজন না হলে আমি দেখিনা, কারণ সময় হয় না। কিন্তু জুলফিকার নিউটনের কথা আমি শুনেছি। আমি যতটুক দেখেছি ওর বেশ কয়েকটি অনুবাদের বই আমার হাতে এসেছে এবং সেই অনুবাদগুলো দেখে আমার নকল বলে সন্দেহ করবার কোন কারণ ঘটেনি। আর আমি আর একটা কারণেও খুব ইমপ্রেস্ড হয়েছি। তার প্রত্যেকটি অনুবাদ গ্রন্থে খুব বড় ভূমিকা আছে এবং সেই ভূমিকাতে মূল লেখকের জীবন এবং সাহিত্য কর্মের কথা আর অনূদিত উপন্যাসের একটি বিশ্লেষণাত্মক আলোচনা থাকে। এই কাজটি কিন্তু আমাদের অনুবাদ যারা করেন তারা অনেকে করেন না। প্রথম পৃষ্ঠা খুলে শুধু মূল বইয়ের নাম দেখা যায়, কোনো ভূমিকা নেই, মূল বইয়ের পরিচয় নেই। সেদিক থেকে আমি জুলফিকার নিউটনের কাজকে ভালই দেখি।


বেবী মওদুদ: দেবী প্রসাদের রুপ-রস-সুন্দর বইটি কলকাতায় আছে। মানবেন্দ্রের অনুবাদে মার্কেজের কিছু গল্প আছে। হুবহু মিলে যায়।


কবীর চৌধুরী: আমি জানিনা, যদি করে থাকে তবে খুবই অন্যায় করেছে এবং আমি সরাসরি তাকে জিজ্ঞেস করবো এরকম করেছে কি না। আর আমাকে যদি তুমি বা আর কেউ নিউটনের ওই রকম নকল করা বই, আর যে বই থেকে নকল করেছে সে-বই আমাকে দিয়ে যাও তাহলে আমি মিলিয়ে দেখবো এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবো।


বেবী মওদুদ: এটা নিয়ে তরুণ সমাজে কিন্তু একটা বিতর্ক উঠেছে। তো, কবীর ভাই, এর পরে আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করবো আপনার পরিবারের কথা। আমাদের মেহের কবীর ভাবী, আপনার স্ত্রী। তিনি তো সেই অবরোধ যুগের সময় লেখা পড়া করেছেন বলা চলে এবং বলা যায় সেই দিনাজপুর থেকে তিনি তার প্রথম দিকের পড়াশুনা করেছেন। পরে কলকাতা গিয়ে পড়াশুনা করেছেন এবং বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনা করেছেন এবং গবেষণার কাজও করেছেন তিনি।


কবীর চৌধুরী: হ্যাঁ। এটা আমার জীবনের অন্যতম সৌভাগ্য আমি বলবো। তার সঙ্গে পরিচিত হওয়া এবং তারপরে জীবনসঙ্গিনী হিসাবে তাকে পাওয়া। তিনি পড়াশুনা করেছেন কলকাতায়, ফলিত রসায়নে পড়াশুনা করেছেন এবং তার সৌভাগ্য হয়েছে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের সঙ্গে থাকার। তিনি তখন ক্লাস নিতেন না কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অংশে তাঁর থাকার ঘর ছিল। তিনি প্রতিদিন আসতেন এবং আমার স্ত্রীকে খুব স্নেহ করতেন। একটি মুসলমান মেয়ে সেই ১৯৪২/৪৩ সালে ফলিত রসায়ন নিয়ে এম. এস. সি. পড়ছে, এটা তাঁকে খুব আনন্দ দিতো।


বেবী মওদুদ: তারপর তিনি আপনাদের বাড়ীর বউ হয়ে আসলেন। আপনারা তো অনেক ভাই-বোন, সেটা একটা বিরাট ব্যাপার ছিল।


কবীর চৌধুরী: হ্যাঁ, সেটা বিরাট ব্যাপার ছিল। আর আমার তিন কন্যা প্রতিভাবান এবং তার পেছনে তাদের মায়ের ভূমিকাই বেশী। তিনি খুব ভালো ভাবে ওদের গড়ে তুেলছেন। আমার স্ত্রী কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে আসেন ১৯৪৩ সালে, তারপরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টে রিসার্চ স্কলার হিসাবে তিনি কাজ শুরু করেন। বিষয়টি খুব ভাল ছিলো। সালফেট কি করে সারের কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে তিনি সেই গবেষণার কাজটা করছিলেন এবং অনেকখানি এগিয়ে গিয়েছিলেন এবং তার আর সামান্য কাজ করলেই তার পিএইচডি হয়ে যেত। কিন্তু তার পরে দুই বাংলার বিভেদ ও পাকিস্তান হওয়ার পরে তার থিসিস যতটুকু হয়েছিল তার কাগজপত্র হারিয়ে যায়। পরে কাজটা আর শেষ করা হয় নি। তবে যাই হোক, তিনি পরে লেখালেখির জগতে আসেন এবং বেশ কয়েকটি বই অনুবাদ করেছেন। অনেক জায়গায় শিক্ষকতাও করেছেন বিশেষ সাফল্যের সঙ্গে।
বেবী মওদুদ: নিজের স্মৃতি কথাও লিখেছেন।


কবীর চৌধুরী: তুমি পড়েছো সেটা। আর আমার মেয়েদের ক্ষেত্রে পরিবারের কথা জিজ্ঞেস করলে, তারই উৎসাহে, আমি কিছু হয়তো সাহায্য করেছি, আমার তিন কন্যা উল্লেখযোগ্য যোগ্যতা নিয়ে বড়ো হয়েছে। বড় মেয়ে শাহীন কবীর ডাক নাম রীনু। তুমি তো জান ও ইংরেজির অধ্যাপক, আমারই মতো এবং প্রচুর কাজ করে। সারা দেশে ইংরেজী শিক্ষাদানের জন্য ও ‘ইংলিশ ফর স্কুলস’ নামে ডেইলী স্টার নামের ইংরেজি সংবাদ পত্রে প্রতি সপ্তাহে একটি পাতা বের করে। সেটা খুব জনপ্রিয় হয়েছে। ছাত্রছাত্রীদের উপকারেও আসছে। আমার মেজ মেয়ে নিউইয়র্ক প্রবাসী। তাকে ও আমার জামাতা দুজনকেই তুমি চেনো। জামাতা সেলিম জাহান অর্থনীতির অঙ্গণে সুপরিচিত। সে নিউইয়র্কে ইউএনডিপিতে উচ্চপদে কর্মরত। আমার মেয়েও ওই খানে থাকে আর এই মেয়েও ফ্রিল্যান্স গবেষক হিসেবে ইউএনডিপির সঙ্গে কাজ করে। আর ছোট মেয়ে মস্কো থেকে গাইনোকলজিতে পিএইচডি করেছে। বাংলাদেশে ফিরে বিসিএস দিয়ে সরকারি চাকুরি নেয়। সাত আট মাস পরে সে ঐ চাকুরী ছেড়ে দেয়। ছেড়ে দিয়ে সে নিজের উদ্যোগে এখন দক্ষিণ বাংলার গ্রামাঞ্চলে ক্লিনিক স্থাপন করেছে। একটা নার্সেস ট্রেনিং স্কুল স্থাপন করেছে। ঐখানে কাজ করে। এই হলো তিন মেয়ের পরিচয়।


বেবী মওদুদ: তো আপনার কি মূল্যায়ণ আপনার মেয়েদের সম্পর্কে ?


কবীর চৌধুরী: মেয়েদের জন্য আমি গর্ববোধ করিতো বটেই এবং আমি অত্যন্তু সুখী এইদিক থেকে যে ওরা সবসময় আমার সঙ্গে নানা বিষয় আলোচনা করে। বড় মেয়ে তো স্বাভাবিক কারণেই। ইংরেজীর অধ্যাপক আমি। কিন্তু আর দুই মেয়ের ইংরেজীর সঙ্গে যোগ না থাকলেও আমার দৃষ্টিভঙ্গীর কারণে এবং আমি যে তাদের মতে একজন ভাল মানুষ এই অনুভূতি থেকে আমরা খুব কাছাকাছি আছি।


বেবী মওদুদ: আপনার কাছে আমরা অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর কথা শুনতে চাই। মুনীর চৌধুরীকে আজকের প্রজন্মের অনেকেই দেখে নি। কিন্তু তার কথা অনেকেই জানে, শোনে এবং তার লেখা বইও পড়ে। কিন্তু তিনি তো একাত্তর সালে অন্য কোথা চলেও গেলেন না, এখানেই থেকে গেলেন।


কবীর চৌধুরী: হ্যাঁ। এটাতো একটা ট্রাজিক ঘটনা, মুনীরকে হারানো। মুনীরকে নিয়ে যাওয়ার জন্য লোক এসেছে পশ্চিম বাংলা থেকে। বাংলাদেশের কিছু অনুরাগীজন যারা তার সম্পর্কে চিন্তিত ছিল। ওরা তাকে নিয়ে যেতে চেয়েছেন বার বার। ওর ছেলে ভাষণ চলে গিয়েছিল, মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিল। কিন্তু ও গেল না। ঠিক কেন বলতে পারবো না। কয়েকটি কারণ অবশ্য বোঝা যায়। সে মাকে ছেড়ে যেতে চায়নি নিজের নিরাপত্তার জন্য। আর তখন পর্যন্তু তো বুদ্ধিজীবী নিধন শুরুও হয়নি কাজেই ঐ রকম যে একটা বাস্তব আশঙ্কা সেটাও সে বুঝতে পারে নি। এসব কারণে ও যায়নি। আর তার ক্ষতি অপুরনীয়। তুমি ওর কথা জিজ্ঞেস করলে, আমার স্মৃতি সম্পর্কে। ছোট বেলার অনেক স্মৃতি আছে আমার। আমরা পিঠাপিঠি ভাই ছিলাম। কতো গল্প হতো। ওর তো নাটকের দিকে ঝোঁক ছিল। নতুন নাটক লেখার পরে আমাদের বাড়ীতে চলে আসত। সকলে গোল হয়ে বসতাম। তারপরে নাটক পড়ে শোনাত। আর ও যখন বিদেশে ছিল তার কিছু খুব সুন্দর স্মৃতি আছে। যখন ভাষাতত্ত্ব নিয়ে হার্ভার্ডে পড়াশুনা করছে, সেই সময় আমি এবং আমার স্ত্রী ফুলব্রাইট বৃত্তি নিয়ে অন্য একটা প্রোগ্রামে আমেরিকায় গিয়েছিলাম। তখন বোস্টনে ওর বাড়িতে আমরা গিয়েছি। অনেক কথা হয়েছে, গল্প হয়েছে। বোস্টনের চার্লস নদীর পাশ দিয়ে আমরা হেঁটে যেতে যেতে নানা কথা বলেছি। সেই সময় মুনীর ইউজিন ওনীলের ‘লঙ্গ নাইটস জার্নি ইন্টু নাইট’ নাটকটি আমাকে উপহার দিয়েছিল। দিয়ে বলেছিল, একটা অসাধারণ নাটক। কোন একসময় আপনি যদি অনুবাদ করেন তাহলে খুব ভাল হবে। আমি সেটা অনুবাদ করেছি। প্রায় দশ বছর পরে।


বেবী মওদুদ: তো মনীর চৌধুরী একজন অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। আমি দেখেছি, তখন ঢাকা ইউনিভারসিটির ছাত্রী ছিলাম। স্যারের ক্লাসের লেকচার শোনার জন্য নির্দিষ্ট ছাত্র ছাড়াও অন্যান্য বিভাগের ছাত্ররাও এসে বসে থাকতো।


কবীর চৌধুরী: ওর বাচন ভঙ্গি অসাধারণ ছিল। পরবর্তী সময় ওর ছাত্রদের কেউ কেউ ওর ধারাকে গ্রহণ করার চেষ্টা করেছে। যেমন মনিরুজ্জামান, আবু হেনা মোস্তাফা কামাল। মুনীরের গলা খুব অসাধাণর সুরেলা বা সুমিষ্ট ছিল না। বরং একটু ভাঙ্গা ভাঙ্গা ছিল। কিন্তু বলার ভঙ্গি এবং বিষয়ের উপর অধিকার অসামান্য ছিল। আর একটি জিনিশ, বাংলার অধ্যাপক, কিন্তু প্রথমে সে ইংরেজীতে এম. এ. করেছিল। চমৎকার ইংরেজী লিখতো ও বলতো। বাংলায় ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট পেল জেল থেকে পরীক্ষা দিয়ে। তখন তো ভাষা আন্দোলন চলছিলো।


বেবী মওদুদ: তিনি তো ‘কবর’ নাকটটাও জেলে বসে লিখেছিলেন।


কবীর চৌধুরী: তারও ইতিহাস খুব চমৎকার। রনেশদা, অর্থাৎ রণেশ দাশগুপ্ত। তিনিও তখন কারাবন্দি। তিনি মুনীরকে অনুরোধ করেন: ‘ভাষা আন্দোলনের ওপর তুমি একটা নাটক লেখ এবং এমনভাবে লেখ যাতে আমরা কারাগারে থেকে তা অভিনয় করতে পারি।’ সে তো তোমাদের মনে আছে। আধো অন্ধকার। টিম টিমে আলো, একটা ভুতুড়ে পরিবেশ। চটের কাপড় দিয়ে মঞ্চ সাজানো হয়। কারাগারেই ‘কবর’ অভিনীত হয়েছিল। তার পর থেকে আজ পর্যন্তু বাংলাদেশের সর্বাধিক সংখ্যক অভিনীত নাটকের নাম যদি করা যায় তাহলে সেটা ‘কবর’ই হবে। সারাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে, ঢাকা শহরে, নিয়মিতভাবে কবর অভিনীত হয়। আর মুনীরের রুপান্তর বা অনুবাদের কাজও অসামান্য। ‘মুখরা রমণী বশীকরণ’ শেক্সপিয়ারের অসাধারণ অনুবাদ। গলসওয়ার্থের ‘রুপার কৌটা’ও মুনীর রুপান্তর করেছে। তার প্রতিভা ছিল বহুমুখী। গবেষণামুলক কাজে মীর মোশারফ হোসেনের ওপর তার লেখা এবং ‘তুলনামুলক সাহিত্য’ প্রভৃতি খুব বড়ো মাপের কাজ। আমাদের দেশে তো তখন পর্যন্তু কমপারেটিভ লিটারেচার নিয়ে খুব বেশী লেখা হয় নাই। মুনীরই তার পথিকৃত। তার প্রতিভা ছিল বিভিন্ন মুখী। তার উদ্ভাবিত টাইপ রাইটার, ‘মুনীর অপটিমা’ নামে, তাও ছিল একটি অসামান্য কাজ। মুনীরকে হারাবার ক্ষতি পুরণ হয় নি। হবারও নয়।


বেবী মওদুদ: আপনাদের পরিবারেই শুধু নয় এটা আমাদের সমাজে, আমাদের শিল্পে, আমাদের সাহিত্যে, আমাদের দেশের জন্য খুব বড় ক্ষতি হলো।


কবীর চৌধুরী: হ্যাঁ, খুব বড় ক্ষতি হলো। আর খুব বড় করে আমাদের বুকে বাজে, সে ওই কাজগুলো করেছে শত প্রতিকূলতার মুখে। আজকে তো খুব অনুকূল অবস্থা ঐ ধরনের কাজ করার জন্য। এই সময় ও আমাদের মধ্যে থাকলে আরো কত কাজ করতে পারতো।


বেবী মওদুদ: তো কবীর ভাই এইযে বর্তমান সরকার, এ সরকারতো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সরকার, গণতান্ত্রিক সরকার। এই সরকারের কাছে আপনার ব্যক্তিগত কোনো প্রত্যাশা আছে?


কবীর চৌধুরী: আমার প্রত্যাশা তো অনেক এবং আমি মনে করি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিকতায় কোনরকম খাঁদ নেই। তিনি সত্যিই চান যে বাংলাদেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাক। কিন্তু নানা রকম বাধা আছে, নানা রকম প্রতিকুলতা আছে। সেগুলো জয় করতে হবে। একটা পদক্ষেপ নিবেন বলে তিনি কড়া ভাষায় বলেছেন। আমাকে যেটা পীড়া দেয় সেটা হচ্ছে যে ছাত্রলীগ বা ছাত্রদল তাদের অনুগামী যে সব অঙ্গ সংগঠন আছে তাদের ছেলেরা টেন্ডারবাজী চাঁদাবাজী ইত্যাদি করছে।


বেবী মওদুদ: শেখ হাসিনা এসব বন্ধ করতে বলেছেন।


কবীর চৌধুরী: হ্যাঁ। তিনি এ বিষয় সচেতন এবং তিনি বলেছেন যে, এটা কঠোর হস্তে দমন করা হবে। কোন ছাড় দেওয়া হবেনা। আমার আশা তার এই কথা বাস্তবায়িত হবে।


বেবী মওদুদ: এখন অনেক জায়গায় হচ্ছেও।


কবীর চৌধুরী: হ্যাঁ, কিছু বাস্তবায়িত হচ্ছে। শেখ হাসিনার উদ্যোগের আর একটা দিক আছে যা প্রশংসনীয়। তা হচ্ছে তরুণ নেতাদের সামনে নিয়ে আসা। এই কাজগুলো হচ্ছে। আরেকটা কথা বলি। আগেও অবশ্য এটা ছিল। বৃদ্ধ, বয়স্ক, নিঃস্ব, বিধবা এদের সামাজিক অবস্থার উন্নতি সাধন করা। এর উপর জোর দিবেন তিনি। এগুলোতে আমরা খুবই আশান্বিত বোধ করছি। আর দুঃখ হয় যে, বিএনপি বা অন্য বিরোধী দলগুলো মনে হয় শুধু বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা করছে। তাদের কার্যকর সত্যিকার কোন ইতিবাচক প্রোগ্রাম নেই। এটা খুবই দুঃখজনক।


বেবী মওদুদ: কবীর ভাই আর একটি বিষয় জানতে ইচ্ছে করে আপনি কখনো বাজারে গিয়েছেন। বাজার করতে মানে শাক-সব্জি, চাল, ডাল, তেল, নুন ইত্যাদি কিনতে Ñ


কবীর চৌধুরী: না। এদিক দিয়ে আমি ছিলাম খুবই অকেজো।


বেবী মওদুদ: সবচেয়ে কমদামে চাল কখন খেয়েছেন মনে আছে ? বাজারে কি আপনি কোন দিন
যান নি ? মুনীর স্যারতো সাইকেল চালিয়ে নিউমার্কেটে বাজার করতে যেতেন।


কবীর চৌধুরী: হ্যাঁ। মুনীর বেশ বাজারে যেত। কিন্তু আমার ঐ অভ্যাস কখনই হয়নি।


বেবী মওদুদ: কিন্তু কবি সাহিত্যিকদের এই অভ্যাসটা থাকা ভাল। আপনি কি মনে করেন?


কবীর চৌধুরী: হ্যাঁ, ভালো। ভালো তো বটেই। আমার মনে হয় বাজারে যাওয়া দরকার। কিন্তু কোন কারণে, যাই হোক, আমার সেটা হয়নি। মুনীর উপভোগ করতো বাজারে যাওয়াটা। নুতন কোন জিনিস উঠলে কিনে নিয়ে আসতো। তখন আমরা ধানমন্ডি হাতিরপুলের বাড়ীতে থাকতাম। তার ছেলে ভাষনকে সাইকেলের সামনে বসিয়ে চলে আসতো।


বেবী মওদুদ: আপনি তো জীবনে অনেক বই পড়েছেন, সংখ্যা হয়তো মনে নেই যে, কত বই পড়েছেন। তো কোন বইটা আপনার বার বার পড়তে ইচ্ছে করে।


কবীর চৌধুরী: বাংলা বইয়ের মধ্যে আমি বলবো ‘গোরা’ আমাকে বার বার পড়তে টানে। বার বার আকর্ষণ করে লেখার ভঙ্গির জন্য এবং সেখানে পরিবেশিত জীবন দর্শনের জন্য। বিশেষ করে আনন্দময়ী চরিত্রের জন্য। এক অসাধারণ চরিত্র। ‘গোরা’ পড়তে বার বার ইচ্ছে করে। আর বিদেশি বইয়ের মধ্যে বেশ কয়েকটি বই একাধিকবার পড়তে ইচ্ছে করে। পাস্তারনাকের ‘ড: জিভাগো’, ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’ রোমা রঁল্যার ‘জাঁ ক্রিস্তফ’, টলস্টয়ের ‘ওয়ার অ্যান্ড পীস’, ফ্লবেয়ারের ‘মাদাম বোভারি’Ñএতো বার পড়া সত্বেও আবারও পড়তে ইচ্ছে করে। তুলনামূলকভাবে সাম্প্রতিক কালের দিকে যদি তাকাই দক্ষিণ আফ্রিকার কোয়েৎজির একটি বই আছে, ‘লাইফ এ্যান্ড টাইম্্স অব মাইকেল কে’। আমি বাংলায় নাম দিয়েছি ‘অবিস্ম^রণীয় মাইকেল কে’। একটু নাম বদলে দিয়েছি আমি। বইটা একাধিকবার পড়তে ইচ্ছে করে। ওই বইয়ের মূল জিনিস হচ্ছে সকল প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে মানুষ সহিষ্ণুতা, মনোবল এবং ভালবাসা দ্বারা সব জয় করতে পারে। এইটাই প্রধান। আমি ওটা বাংলায় অনুবাদও করেছি।


বেবী মওদুদ: তাহলেতো এই বইটা নিশ্চয়ই আপনার খুব প্রিয় বই।


কবীর চৌধুরী: হ্যাঁ।


বেবী মওদুদ: তো আপনি আজকের যে প্রজন্ম, নতুন তরুণ যারা আসছে আমাদের ভবিষ্যতে, তাদের উদ্দেশে কিছু বলুন।


কবীর চৌধুরী: আমি উপদেশ দেওয়ায় বিশ্বাস করি না। তবে তাদের সাথে কথা বলতে ভাল লাগে এবং তাদের সঙ্গে কথা বললে আমি যে কথার উপর জোর দেব তার একটা হচ্ছে যে সততাটা খুব দরকার। পরিশ্রম দরকার। ফাঁকি দিয়ে বড় কিছু পাওয়া যায় না। আমাদের এখানে অনেকেই খুব দ্রুত সাফল্য চায়। কিন্তু পরিশ্রম করতে হবে। ধৈর্য রাখতে হবে এবং সৎ থাকতে হবে।


বেবী মওদুদ: এটা এক নাম্বার ?


কবীর চৌধুরী: হ্যাঁ, এটা খুবই দরকারি। আর পড়াশুনা করতে হবে। একসময় তো তরুণরা বেশ পড়তো। আমাদের সময় যখন আমরা ছিলাম ইউনিভার্সিটিতে পড়েছি, মনে আছে আমরা কত বিষয় নিয়ে আলোচনা করতাম। কিন্তু এখন ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে তাদের নিজেদের পড়ার বিষয় ছাড়া আর কোন বিষয়ে তেমন আলোচনা হয় না। হয়তো ফিল্ম-এর কথা কিছু হতে পারে, ইন্টারনেটে দেখে। কিন্তু সিরিয়াস কথাবার্তা বলার জন্য তো পড়াশুনা করতে হবে, গভীরভাবে ভাবতে হবে। আমাদের নিজেদের শ্রেষ্ঠ লেখকদের লেখাও পড়তে হবে। তুমি গিয়ে জিজ্ঞেস করে দেখ আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের লেখা বই ক’জন যুবক ক’টা পড়েছে। হাসান আজিজুল হকের বই ক’জন ক’টা পড়েছে ? এগুলোতো পড়া দরকার।


বেবী মওদুদ: তো কবীর ভাই, আপনাকে কষ্ট দিলাম, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। সবার পক্ষ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ জানাই কৃতজ্ঞতা জানাই যে আপনি আমাদেরকে দীর্ঘ সময় দিয়েছেন। আমাদের সাথে কথা বলেছেন। আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করবে আপনার কথাগুলো। কারণ আপনার জীবনের যে অভিজ্ঞতা সেটা একটা বিরাট অভিজ্ঞতা এবং সেটা আমাদের কাছেও অত্যন্ত মূল্যবান। আমাদের জীবনে এটা অনুসরণ করা, একটা আদর্শ একটা নীতি নিয়ে এগিয়ে যাওয়া খুব দরকার।


কবীর চৌধুরী: তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। তোমার সঙ্গে তো আমার দীর্ঘ দিনের পরিচয়। তোমার বাবাকে চিনতাম আমি।


বেবী মওদুদ: আপনার কাছে আমরা কৃতজ্ঞতা জানিয়ে এখানেই শেষ করছি।


২৩ জানুয়ারি ২০১০ ১০:২৭ অপরাহ্ন

রবিবার, ৮ এপ্রিল, ২০১২

লেখক যদি পাঠকেরকথা ভেবে লিখতে থাকে তবে সর্বনাশ - শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

‘আমার লেখার কোন ছক নেই। পরিকল্পনা নেই। লিখতে বসার আগে পর্যন্ত জানি না কী লিখবো। একটা মনে ধরার মত লাইনের জন্য অপেক্ষা করি। যদি ওই বাক্যটি পছন্দ হয় লিখতে শুরু করি। আমার লেখার ধরন অনেকটা তুলোর গুটি থেকে সুতো পাকানোর মত। ধীরে ধীরে একেকটি চরিত্রকে দেখতে পাই। তাদের মুখ, শরীর কাঠামো, পোশাক ভেসে ওঠে চোখের সামনে। তাদের জীবনযাত্রা, কথা দেখতে পাই। তখন আমার গল্প, উপন্যাস যেন হয়ে ওঠে একটি প্রতিবেদন লেখার মত। তবে এভাবে লেখা প্রত্যাশিত নয়। আমার ধরনটা বৈজ্ঞানিকও নয়। কিন্তু আমি নিরূপায়।’ বলছিলেন বাংলা সাহিত্যের অতুলনীয় লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। গতকাল রবিবার সকালে দৈনিক ইত্তেফাকের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় তিনি এসব কথা বলেন।
শীর্ষেন্দু বলেন, ‘এমনও হয়েছে, বাক্যে একটি শব্দ খুঁজতে গিয়ে ১২-১৩ দিন লিখতে পারিনি। আবার কোন কোন দিন ১২-১৩ ঘণ্টা টানা লিখে গেছি। বাড়ির রান্না ঘরে যেমন অনেক তরকারি থাকে। কিন্তু সব নিয়ে তো রান্না হয় না। কিছু কিছু জিনিস নিয়ে একেক দিন রান্না হয়। প্রতিটি লেখকেরও তেমনি রান্না ঘর রয়েছে। কিন্তু তার অভিজ্ঞতা ও ভাবনায় যখনই যা আসে তা সে লেখে না। এসব জিনিসকে মজতে দিতে হয়। এরপর সে ঠাকুর ঘরে ঢুকে দেখবে যে সে কী লিখবে। ভাবনা চিন্তা ও অভিজ্ঞতাগুলোকে মজতে দিলে তা একদিন ত্রিমাত্রিক রূপ নিয়ে ফুটে উঠবে।’ তিনি বলেন, “পাঠকের কাছে আমার কোন প্রত্যাশা নেই। প্রত্যাশা রেখে লিখি না। তাহলে আপোষ করতে হতো। ১৯৬৭ তে ‘ঘূণপোকা’ যখন লিখি তখন তা পাঠক সেভাবে গ্রহণ করেনি। কেউ কেউ বলেছে, ওর লেখা পড়ো না মাথা খারাপ করে দেবে। কিন্তু আমি আমার বলবার ভাষা ও চিন্তাতে পরিবর্তন করিনি। আমার মতো করে লিখে গেছি। তবে দেরিতে হলেও পাঠক আমার লেখা গ্রহণ করেছে। পাঠকের সঙ্গে একটা সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে।’
শীর্ষেন্দু বলেন, “লেখক যদি পাঠকের কথা ভেবে লিখতে থাকে তবে তা সর্বনাশের ব্যাপার। খ্যাতি মানুষের বড় শত্রু। খ্যাতির জন্য, প্রতিষ্ঠার জন্য লেখা চলবে না। তা যদি কোন লেখক লেখে তবে লেখা তাকে ছেড়ে চলে যাবে। লেখক হতে গেলে তাকে অবশ্যই বৈরাগ্য অবলম্বন করতে হবে, সন্ন্যাসী হতে হবে। নিজের লেখার সমালোচক হতে হবে। এমনও হয়েছে আমি নিজের লেখা উপন্যাসের প্যার পর প্যারা, পাতার পর পাতা ফেলে দিয়েছি। নিজের লেখার ‘মার্সিলেস এডিট’ করতে হবে।”
শীর্ষেন্দু বলেন, ‘একটা সময় ছিল আমরা পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বাংলা ভাষার ভবিষ্যত্ নিয়ে চিন্তিত ছিলাম। বাংলাদেশ রাষ্ট্র জন্মের পর সেই দুশ্চিন্তা কেটে গেছে। কারণ বাংলাদেশ ভাষাভিত্তিক দেশ। পৃথিবীতে বাংলার স্বীকৃতি এ দেশের জন্যই।’
বাংলা গদ্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বাংলা গদ্যের চর্চা খুব কম হচ্ছে। বাংলা শব্দের ভাণ্ডার খুব কম। যদি নতুন নতুন বাক্য গঠন প্রণালীর চর্চা না করা হয়, তবে গদ্য খুব সাদামাটা হয়ে যাবে। অনেক লেখকেরই ভাবনা হয়তো খুব নতুন, উপযুক্ত। কিন্তু উপযুক্ত বাক্যে তা বলা না হলে ভাবনাটা মরে যায়। এর জন্য পরিশ্রম করতে হবে। অনুশীলন করতে হবে। পরিশ্রম না করলে তো কিছুই হবে না। এর পেছনে যন্ত্র ও প্রযুক্তি নির্ভরতাও রয়েছে। না চাইতেও এর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত জীবন। এই যে, সেলফোনে মানুষ এত কথা বলে, এত কথা কিন্তু তার নেই। কিন্তু কথা বলতে বলতে বাসে চাপা পড়ে সে মারাও যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে এই সেল ফোন আমরা কথা বলতে না চাইলেও বলতে বাধ্য করছে। এইভাবে প্রযুক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছি। প্রযুক্তির কারণে ভাষা বদলে গেছে। মানুষ বেশি কথা বলছে। ভাবনার ধরন বদলে গেছে। আর সৃজনশীলতা কমে গেছে। এই প্রভাব কাটানো সম্ভব কিনা জানি না।’
নিজের প্রসঙ্গে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘আমি সবসময় একটা চেতন অবচেতনে বিরাজ করি। অনেক সময় মনেও থাকে না আমি লেখক। অদ্ভূত ধরনের এক অন্যমনষ্কতা কাজ করে। রাস্তাঘাটে আমি খুবই অনিরাপদভাবে চলাচল করি। একজন ব্যক্তি অনেক টুকরোতে বিভক্ত হয়ে জীবনযাপন করে। স্ত্রীর স্বামী, সন্তানের বাবা, দোকানির খদ্দের। আমিও তাই। কিন্তু রাতে যখন একা হই তখন আমি ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ মানুষ হয়ে উঠি। নিজেকে ফিরে পাই। তবে চেতনে অবচেতনে বিরাজ করলেও আমি জীবনকে উপভোগ করার চেষ্টা করি। আমার জীবনে ডাল ডে বলে কিছু নেই। প্রতিটি দিন উপভোগ করি।’
তিনি বলেন, ‘এক গভীর অবসন্নতা থেকে আমি ঠাকুর অনুকূল চন্দ্রের শিষ্যত্ব গ্রহণ করি। এরপর থেকে আমি যেমনতেমন জীবনযাপন করা ছেড়ে দিলাম। অনুশাসন মেনে চলা শুরু করি। তারই জন্য আমার জীবন ঊষর থেকে উর্বরা হয়েছে। জীবনে সংগ্রাম কম করতে হয়নি। নিদারুণ অভাব দেখেছি। ঘরে চাল থাকতো না। এসবই হয়েছে আমার জীবনাচরণের দোষে। নিজেকে বদলে ফেলার সঙ্গে সঙ্গে আমার জীবন থেকেও সমস্যা কাটতে থাকে। স্বচ্ছল না হই, অভাবক্লিষ্টতা কেটে গেল। ঠাকুরের বাণী নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ানো আমার কাছে অমৃতস্বরূপ। গ্রামে যাদের কাছে যাই, তাদের কাছে আমি লেখক নই—গুরুভাই। তাদের সঙ্গে কোন দূরত্ব থাকে না। তখন আমার সঙ্গে সবার একটা সহজ সম্পর্ক হয়। এই ঘোরাফেরা ও মেলামেশার মধ্য দিয়ে আমি জীবনের এক শাশ্বত রূপ দেখতে পেয়েছি।
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘মাঝে মাঝে মনে হয়, কেন বেঁচে আছি। আমরা অসীমের মধ্যে বাস করি। কিন্তু জীবন নির্দিষ্ট। অনন্ত, অসীম বলে কিছুই কী নেই? সবকিছুই কী সময়ের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ?— এসব চিন্তা মানুষের অবচেতনে থাকে। সে এসবে প্রভাবিত হয়ে অবসন্নতা বোধ করতে থাকে। মানুষ বাস্তবতা ও কল্পনা উভয় জগতে বাস করে। দুটো স্বত্বাই সক্রিয় থাকে। আমার লেখায় মানুষের দুই অবস্থা তুলে এনেছি।
সাংবাদিকতা ও লেখক স্বত্বায় কখনো দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করেনি? জবাবে শীর্ষেন্দু বলেন, ‘দেশ পত্রিকায় এখন সেভাবে সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত থাকতে হয় না। তবে যখন সাব এডিটর ছিলাম তখন স্পেশাল রিপোর্টিং-এর জন্য নানা জায়গায় যেতে হয়েছে। সেই কাজগুলো আমাকে বাস্তববাদী হতে সহযোগিতা করেছে। সাংবাদিকতার গদ্য ও এডিটিং স্টাইল আমার লেখায় উপকারে এসেছে। কারণ সাংবাদিকতার ভাষা অনেক বেশি কারণমুখী ও বাস্তবমুখী। প্রতিবছর বাজেটের কপি আমাকে দেখিয়ে নেয়া হতো। কারণ অফিস মনে করতো আমি বাজেটে মানুষের প্রত্যাশার হূদস্পন্দন ধরতে পারি। ফলে সাংবাদিকতা আমার মাঝে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করেনি।’
আত্মজীবনী লিখবেন?—জবাবে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘উপন্যাসে নিজের জীবনের অনেক কথাই চলে আসে। নিজে থেকে কখনো লেখার তাগিদ অনুভব করিনি। তবে যখন ছেলে, স্ত্রীকে জীবনের নানা অভিজ্ঞতার কথা বলি তখন তারা তাগিদ দেয় সেই কথাগুলোকে লিখে রাখবার জন্য। বার বার বলেছে। কিন্তু আমি অলস মানুষ। দায়ে না পড়লে লিখি না।’
শীর্ষেন্দুকে ঘিরে আড্ডা : শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের সম্মানে ধানমণ্ডির বেঙ্গল শিল্পালয়ে কালি ও কলম পত্রিকা গতকাল এক আড্ডার আয়োজন করা হয়। এ সময় দেশের বুদ্ধিজীবী, কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গে নানা আলোচনায় মেতে ওঠেন তিনি। বিভিন্ন জনের প্রশ্নের জবাব দেন। আড্ডায় উপস্থিত ছিলেন প্রফেসর ইমেরিটাস আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, কালি ও কলম সম্পাদক আবুল হাসনাত, আসাদ চৌধুরী, শিল্পী সমরজিত্ রায় চৌধুরী, বিশ্বজিত্ ঘোষ, আন্দালিব রাশদী, মাকিদ হায়দার, আনিসুল হক প্রমুখ।

শুক্রবার, ৩০ মার্চ, ২০১২

পরিস্থিতি বাউলকে বদলে দিচ্ছে - পবন দাস বাউল

দেশ টিভির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানমালায় গান করতে তিন দিনের জন্য ঢাকায় আসেন পবন দাস বাউল। গতকাল বিকেলে চলে যান কলকাতায়। ঢাকায় তিনি থেকেছেন ঢাকা ক্লাবের অতিথিশালায়। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে এখানেই কথা হলো প্যারিস-প্রবাসী এই কণ্ঠশিল্পীর সঙ্গে।

ঢাকায় এসে কেমন লাগছে?
গরমটা বেশি। আগেও এসেছি। কখনোই বেড়ানো হয় না। গান গেয়েই ফিরে যাই। দেশ টিভিতে বুধবার রাতে গান করেছি। অনেকেই ফোন করেছেন। ভালোই লেগেছে।
বাংলাদেশের শিল্পীদের গান শোনা হয়?
আব্দুল আলীম, আব্বাসউদ্দীন আহমদ, নির্মলেন্দু চৌধুরী, মুজিব পরদেশীর গান শুনেছি। আগেরবার যখন এসেছিলাম, তখন অনেকেই আমাদেরকে বিভিন্ন শিল্পীর ক্যাসেট উপহার দিয়েছিলেন। সেগুলো প্যারিসে নিয়ে যাই। মাঝে মাঝেই শোনা হয়।
একটু পেছন ফিরে যেতে চাই। বাউলগানের সঙ্গে যুক্ত হলেন কীভাবে?
আমার জন্ম মুর্শিদাবাদে, গ্রামের নাম মোহাম্মাদপুর। বাবা দিবাকর দাস কীর্তন ও কবিগান করতেন। আমাদের অল্প কিছু জমি ছিল। তাতে বাবা চাষ করতেন। বাবা লাঠিখেলায় খুব দক্ষ ছিলেন। কুস্তিও লড়তেন। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। জমি বিক্রি করে চিকিৎসা করালেন। লাভ হলো না। আর কাজ করতে পারেননি। তখন আমার বয়স ছয় বছর। ঘরে বাবা-মা ভাইবোনসহ সাতজন। এরপর বাবা ভিক্ষা শুরু করলেন। মাধুকরি গান গাইতেন। বাবা প্রথম লাইন বলতেন, আমি তাঁর সঙ্গে দোহারি করতাম আর নাচতাম। বাবার সঙ্গে মাধুকরি করতে গিয়ে আমি অনেক জায়গায় ঘুরেছি—বাজারে, রাস্তায়, ট্রেনে—কত জায়গায় যে গান করেছি, হিসাব নেই। ওই সময় বাউলগান দারুণ পছন্দ হয়। বাউলগানের কথা আর সুর আমাকে দারুণ নাড়া দেয়। সেই থেকে বাউলগান বেছে নিই।
আপনার পড়াশোনা?
একেবারেই হয়নি। অভাবের কারণে করতে পারিনি। বাবা আমাকে বর্ণগুলোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন।
শুনেছি, আপনি অনেক বছর ধরে ফ্রান্সের প্যারিসেই থাকছেন। প্যারিসে গেলেন কবে?
১৯৮১ সালে। বয়স তখন ২৬-২৭। রেডিও ফ্রান্স আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। এর আগে ফ্রান্স টিভি থেকে বাউলদের ওপর একটা তথ্যচিত্র তৈরি করে। নাম সং অব দ্য ম্যাড ম্যান (পাগলদের গান)। গৌর ক্ষ্যাপা, রমানন্দ আর আমাকে নিয়ে। সঙ্গে আরও অনেক বাউল ছিলেন। তা দেখে রেডিও ফ্রান্স আমাকে আমন্ত্রণ জানায়। পরের বছর ১৯৮২ সালে আমন্ত্রণ জানায় ফ্রান্সের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। এর পর থেকে প্রায় নিয়মিতই কলকাতা ও প্যারিসের মধ্যে যাওয়া-আসা হচ্ছে। বেশিটা সময় প্যারিসেই থাকছি।
আপনার খুব জনপ্রিয় একটি গান ‘বসুন্ধরার বুকে’।...
‘বসুন্ধরার বুকে’ আমার দাদার লেখা গান। বাংলা ১৩৮৫ সনে খুব বন্যা হলো। দুর্গাপূজার কদিন আগে কলকাতায় আমার একটা অনুষ্ঠান ছিল। অনুষ্ঠান শেষে বাড়ির সবার জন্য নতুন কাপড় কিনেছি। এমন বৃষ্টি হলো যে সারা কলকাতায় বন্যা হয়ে যায়। ওই দিন ফিরতে পারিনি। ওদিকে দুর্গাপুরে আমাদের একটা মাটির ঘর ছিল। বৃষ্টি আর বন্যায় সেই ঘর ভেঙে যায়। বাড়ির সবাই স্কুলে গিয়ে আশ্রয় নেয়। ওই ঘটনাটি নিয়েই তৈরি হয়েছে এ গান।
আর ‘দিল কি দয়া হয় না’?
এই গান পেয়েছিলাম এক বাউলের কাছ থেকে। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে তাঁর গানটি শুনেছিলাম। পরে তাঁর কাছ থেকে লিখিয়ে এনেছিলাম। গানটা কে লিখেছেন, আসল সুর কোনটা, তা জানি না। একটু খেয়াল করলে দেখবেন, এই গানটি কিন্তু আমিও বিভিন্ন সুরে গাই। কারণ, গানটা আমার খুব ভালো লাগে।
আপনাকে বাংলাদেশের শ্রোতারা প্রথম চিনেছে ‘রিয়েল সুগার’ অ্যালবাম দিয়ে। আপনার মোট কয়টি অ্যালবাম বেরিয়েছে?
১২টি। তবে কোনোটিই কলকাতা থেকে নয়, প্যারিস কিংবা লন্ডন থেকে। এর মধ্যে খুব উল্লেখযোগ্য হলো: রিয়েল সুগার (১৯৯৭), ইনার নলেজ (১৯৯৭), স্টেট বেঙ্গল ভার্সেস পবন দাস বাউল (২০০৪), টানাটানি (২০০৪)। বাংলাদেশে এসে তো আমি অবাক, আমার গান হরদম পাইরেসি হচ্ছে। এমন হলে শিল্পী বাঁচবে কী করে!
নতুন অ্যালবামের ব্যাপারে কী ভাবছেন?
ইতালির একটি ছেলে, নাম জুলিয়ানো। ইংল্যান্ডে থাকে। দুই বছর আগে কলকাতায় ওর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের কাছে গিটারের ওপর প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। এখন তার সঙ্গে কাজ করছি। প্যারিস থেকে আসার আগে সাতটা গান তৈরি করেছি।
আপনি বাউলগানের সঙ্গে নানা ধরনের আধুনিক বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করেন। কেন?
আমার পছন্দ, তাই। অনেক অনুষ্ঠানে এ ধরনের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। আমার উত্তর হলো, আমার গানের সঙ্গে কী বাজবে, তা আমি ঠিক করব। কারও পছন্দ না হলে শুনবে না। ডাকবে না আমাকে।
আপনি নিজেও অনেক বদলে গেছেন। এই পরিবর্তনটা ইতিবাচক বলে মনে করেন?
বাউল কিন্তু সব সময় পরিবর্তন করে গেছে। বাউলগানে কোনো গোঁড়ামি নেই। একটা সময় বাউলেরা গ্রামেগঞ্জে থাকত। সেই পরিবেশ অন্য রকম ছিল। সব বদলাচ্ছে, বাউল কেন বদলাবে না। পরিস্থিতি বাউলকে বদলে দিচ্ছে। বাউলের কোনো সঞ্চয় থাকে না, সব বিলিয়ে দেয়। এখন কিন্তু সঞ্চয়ের দরকার হচ্ছে। বাউলদের মূল কাজ হলো সাধনা। বাউল এখন খাবারের জন্য দৌড়াবে, নাকি সাধনা করবে?
আপনি ফতুয়া আর প্যান্ট পরে এসেছেন। কিন্তু গানের সময় অন্য পোশাক থাকে।
আমি গানের সময় লম্বা আলখেল্লা ব্যবহার করি। এটা আমার অনেক পুরোনো পোশাক। গানের মতো পোশাকটিও আমার একটা পরিচিতি। আমরা আমাদের সম্পদগুলো আজকের বিশ্বের নাগরিক সমাজে নিয়ে যাচ্ছি। পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি। তবে পরিবেশনার ঢং একেবারেই পুরোনো।

দুপুরের খাবার খেতে হবে। সন্ধ্যায় ফ্লাইট। কলকাতায় যাচ্ছেন। সেখানে কদিন থাকার পর ফিরবেন প্যারিসে। সাক্ষাৎকার শেষ হলো। এবার ছবি তোলার পালা। বললেন, ‘সাক্ষাৎকারটি ছাপানোর পর পত্রিকাটি আমাকে পাঠিয়ে দেবেন। রেখে দেব।’
মেহেদী মাসুদ

সোমবার, ৩ অক্টোবর, ২০১১

বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি আজকে একটি কঠিন সময় অতিক্রম করছে : আদিলুর রহমান খান

আদিলুর রহমান খান, মানবাধিকার সংগঠন অধিকার-এর মহাসচিব এবং সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর আইন ভাঙার প্রবণতা, দলীয় স্বার্থে ব্যবহৃত হওয়া, আইনের শাসন, গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলেছেন সাপ্তাহিক বুধবার-এর সঙ্গে। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন বুধবারের নিজস্ব প্রতিবেদক মঈনুল হক




বুধবার : পুলিশ একের পর এক নির্যাতন এবং নিপীড়নমূলক কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে। বিরোধী দল আহূত হরতাল চলাকালীন সময়ে মতিঝিলে বিরোধীদলীয় কর্মীকে মধ্যযুগীয় কায়দায় নিপীড়ন করল।  কিন্তু পুলিশকে এই ধরনের কার্যক্রম থেকে বিরত রাখতে সরকারি কোনো উদ্যোগ নেই। সরকারের এই উদ্যোগহীনতাকে আপনি কিভাবে দেখেন?

আদিলুর রহমান খান : পুলিশ বাহিনীটাই তৈরি হয়েছিল ব্রিটিশ উপনিবেশিক শক্তির লাঠিয়াল হিসেবে। যা পাকিস্তানের নয়া উপনিবেশিক শাসনামলেও বজায় থেকেছে। একমাত্র ’৭১-এর জাতীয় মুক্তির সংগ্রামে অংশ নেওয়ার মধ্য দিয়ে পুলিশ বাহিনীর একটা প্রধান অংশ যে গৌরবজনক অধ্যায়ের সূচনা করেছিল, তা বেশি দূর অগ্রসর হতে পারেনি। কারণ স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই এই পুলিশ বাহিনীর ভেতর থেকেই স্পেশাল ব্রাঞ্চ নামে প্রতিষ্ঠান গঠন করা হয়। রাজনৈতিক কর্মীদের দমন-পীড়নের জন্য তাদের ব্যবহার করা হয়েছে। তখন জাতীয় রক্ষী বাহিনী গঠন করা হয়েছিল। ত্রিশ হাজার বামপন্থী নেতাকর্মীকে তখন হত্যা করা হয়েছে। এরপর বিভিন্ন সরকারের আমলে গোয়েন্দা বাহিনী আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করার নামে মানুষের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন চালিয়েছে এবং তার ধারাবাহিকতা এখনো চলছে। পুলিশ বাহিনী বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সঠিক পথে পরিচালনা করার জন্য যে রাজনৈতিক সদিচ্ছা দরকার, তা আমাদের দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নেই। যদিও তাদের ঘোষণাপত্রে বিভিন্ন সময় ইতিবাচক কথা বলা হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে তারা ক্ষমতায় আসার পরে জনগণ তাদের কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখেনি। বর্তমান সরকার এর আগেও ক্ষমতায় ছিল এবং এখন যারা বিরোধী দলে আছেন তারাও ইতিপূর্বে ক্ষমতায় ছিলেন, কিন্তু জনগণের বন্ধু হিসেবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে যে পরিবর্তনটা আনা দরকার ছিল তা তারা আনেননি।

বুধবার : নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী ইশতেহারের পাঁচটি অগ্রাধিকারমূলক দফার একটিতে অঙ্গীকার করেছিল- আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীগুলোকে দলীয় প্রভাবমুক্ত, আধুনিক ও যুগোপযোগী করে গড়ে তোলা হবে। ইশতেহারের আলোকে এবং মানবাধিকার প্রশ্নে পুলিশের বর্তমান কর্মকান্ড মূল্যায়ন করুন।

আদিলুর রহমান খান : মূলত এসব রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের সময় নির্বাচন পার করার জন্য ইশতেহার দেয়। এটা তারা কতটুকু বিশ্বাস করেন, তা নিয়ে জনগণের মধ্যে যথেষ্ট সংশয় আছে। শুধু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের কথা বলব না, বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের সময়ও বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচন হয়েছিল। যারা যতবার ক্ষমতায় এসেছেন তারা ততবার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিয়েই নির্বাচন পার হয়ে ক্ষমতায় এসেছেন। কিন্তু বাস্তবে তারা সংস্কারের ক্ষেত্রে জনগণের পক্ষে যৌক্তিক যেসব উদ্যোগ নেওয়া উচিত, তা নিতে বারবারই ব্যর্থ হয়েছেন। একজন মানবাধিকার কর্মী হিসেবে বলব, স্বাধীনতার পর থেকে প্রতিটি সরকারের আমলেই মানবাধিকার পরিস্থিতি খারাপ থেকে খারাপতর হয়েছে। যা একটি ভয়াবহ অবস্থার দিকে বাংলাদেশকে ধাবিত করছে। আমাদের দেশে পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কোনোটিরই অবস্থান মানবাধিকারের ক্ষেত্রে সহায়ক নয়। পুলিশ নিয়ত রিমান্ডে নিয়ে মানুষকে নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত। আমিনবাজারে ছয় জন ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় তাদের ভূমিকা ছিল। কোম্পানীগঞ্জে দেখা গেছে পুলিশের মধ্যে যারা অপরাধী, তারা একজনকে জনগণের মধ্যে ছেড়ে দিয়ে পিটিয়ে হত্যায় উদ্বুদ্ধ করেছে। এই বাইরে তো আমরা র‌্যাবের কর্মকান্ড দেখছি। যা আমাদের আবারো স্বাধীনতার অব্যবহিত পরের জাতীয় রক্ষী বাহিনীর কথাই মনে করিয়ে দেয়। পুলিশ বাহিনীর মধ্যে যদি একটা ব্যাপক পরিবর্তন আনা সম্ভব না হয় এবং এদের মধ্যকার অপরাধী সদস্যদের চিহ্নিত করে তাদের বাহিনী থেকে বের করে না দেওয়া যায়, তাহলে এই পুলিশ বাহিনী জনগণের পক্ষের শক্তি হিসেবে কখনোই দাঁড়াতে পারবে না। এ থেকে বেরিয়ে আসার একটাই পথ হচ্ছে জনগণের সচেতন প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ।

বুধবার : গণপিটুনি, বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী নানা কর্মকান্ড অব্যাহত রাখার পরও সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে সব কিছুকে আইনানুগ বলে দাবি করা হচ্ছে। যা দায়মুক্তির নামান্তর। এই অন্যায় দাবির ভবিষ্যৎ প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে?

আদিলুর রহমান খান : ভবিষ্যৎ প্রতিক্রিয়ায় অবশ্যই তাদের এই অন্যায় কাজের জন্য জবাবদিহি করতে হবে। যখন ২০০৮-এর নির্বাচনে নির্বাচিত হয়ে এই মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসেছিল, তখন ফেব্রুয়ারিতে জাতিসংঘের ইউপিআর সেশনে আজকের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন, বিচার-বহির্ভূত হত্যাকান্ডের ব্যাপারে সরকার ‘জিরো টলারেন্স’ দেখাবে। কিন্তু তারপরও বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড অব্যাহত রয়েছে। হেফাজতে এবং রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন অব্যাহতভাবে চলছে। উচ্চতর আদালতের নির্দেশনা থাকার পরও রিমান্ডে নিয়ে নাগরিকদের নির্যাতন করা হচ্ছে এবং দেশে ভয়াবহতম একটা নির্যাতনের পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। এখানে মানুষকে গুম করা হচ্ছে। এই পরিস্থিতি কোনো সভ্য ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে চলতে পারে না। বাংলাদেশের জনগণ যুগে যুগে অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে, লড়াই করেছে এবং রাষ্ট্রযন্ত্র ও সরকারের পরিবর্তন এনেছে। তাই এই পরিস্থিতি বিরাজমান থাকলে জনগণ তার প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য হবে।

বুধবার : পুলিশ নিজেই বেআইনি ঘটনা ঘটাচ্ছে, নিজেই তদন্ত কমিটি গঠন করছে এবং নিজেকে নির্দোষ দাবি করছে। এই স্ববিরোধিতা আইনের শাসনের সঙ্গে সঙ্গতিপরায়ণ কি?

আদিলুর রহমান খান : এই স্ববিরোধিতা কখনোই আইনের শাসনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। বরং এটা আইনের শাসনকে একটা অপশাসনে পরিণত করে। কারণ যারাই অপরাধী সেই অপরাধী চক্রই যদি আবার নিজেদের তদন্তের দায়িত্ব নিয়ে নেয়, তাহলে অপরাধ করে যে কেউই পার পেয়ে যাবে এবং সেটাকেই বলা হয় দায়মুক্তি। এই দায়মুক্তি কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আমিনবাজারে ছয় ছাত্র হত্যার ঘটনায় তদন্ত রিপোর্ট দেওয়ার পর বলা হয়েছে, অভিযুক্তদের ক্লোজ করা হলো। তার মানে হলো যে, দায়িত্ব থেকে কিছুদিনের জন্য প্রত্যাহার করা হলো। সাসপেন্ড করা হলো এবং পুলিশ কতখানি অপরাধী তা দেখা হবে বলে জানানো হলো। এর আগে কিন্তু কায়সার মাহমুদ বাপ্পীর ঘটনাতেও আমরা তদন্ত কমিটি হতে দেখেছি। এ্যাপোলো হসপিটালের স্টাফ আরিফের ক্ষেত্রেও তদন্ত কমিটি হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতা হলো, তদন্ত কমিটি যেগুলো হয় সেগুলোর রিপোর্ট জনসমক্ষে খুব কমই প্রকাশিত হয় এবং তদন্ত কমিটি যে সুপারিশগুলো করে সেগুলো খুব কমই বাস্তবায়িত হয়। পুলিশের ব্যাপারে বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী অন্যান্য বাহিনীর সদস্যদের ব্যাপারে যে তদন্ত কমিটি হয়েছে, তার খুব কমই কিন্তু বাস্তবায়িত হয়েছে এবং সেটা না হওয়ার সংস্কৃতিও দায়মুক্তির সংস্কৃতি। এই দায়মুক্তির সংস্কৃতি বাংলাদেশের ওপর জোরেশোরে চেপে বসেছে। যদি সুষ্ঠুভাবে, নিরপেক্ষভাবে অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করতে না পারে, তাহলে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি মানুষের আস্থা থাকবে না। তখন বাধ্য হয়ে মানুষ এই প্রতিষ্ঠানগুলোর বিকল্প হিসেবে নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবে।

বুধবার : পুলিশ হেফাজতে প্রতিবছর বহু মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। এছাড়া রিমান্ডের নামেও নির্যাতন অব্যাহত রয়েছে। এ ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকলেও পুলিশ তা মানছে না। আদালতের নির্দেশনা লঙ্ঘনের এই প্রবণতা বিচার ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা হ্রাস করবে কি?

আদিলুর রহমান খান : আমাদের দেশে উচ্চতর বিচার আদালতের ২০০৩-এর নির্দেশনায় যে কথা বলা আছে তা নিম্ন আদালত একেবারেই গ্রাহ্য করছে না। রিমান্ডে নিয়ে কিভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে সেই নির্দেশনা না মেনে তারা অনেকটা রাজনৈতিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে। যার ফলে উচ্চতর বিচার ব্যবস্থার প্রতি নিম্ন আদালতের কিছুসংখ্যক বিচারকের মনযোগ না দেওয়া এবং রাজনৈতিক স্বার্থে নির্দেশনা না মেনে চলা একটি ভয়াবহ আইনি সংকটের পরিস্থিতি সৃষ্টির আশঙ্কা তৈরি করেছে। একটি বিষয় হচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্যাতনে যদি কারোর মৃত্যু হয়, বা কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে যদি নির্যাতনের অভিযোগ প্রমাণ হয়, তা হলে অবশ্যই তা ফৌজদারি আইনের অধীনে পড়বে। কিন্তু আমাদের দেশের আইনি ব্যবস্থায় একটা সমস্যা রয়েছে যে, আপনি সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে মামলা করতে চাইলে আপনার অনুমোদন লাগবে। এই অনুমোদনটা সরকারের কাছ থেকে নিতে হয়। সরকার যখন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অন্যায়-অবিচারকে প্রশ্রয় দেয়, তখন কিন্তু মামলা করার অনুমোদন আর পাওয়া যায় না এবং ক্ষতিগ্রস্তরা আইনের আশ্রয় নিতে পারেন না। বিভিন্ন তদন্ত কমিটি আমরা হতে দেখি এবং তদন্ত কমিটির ফলশ্রুতিতে অপরাধীদের শাস্তি দেওয়াটা খুব দুরূহ হয়ে পড়ে। সেই সঙ্গে দেশে আইনের শাসন যদি শক্তিশালী করতে হয়, তাহলে ফৌজদারি বিচার কার্যক্রমকেও শক্তিশালী করতে হবে। দুর্বল ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থা দিয়ে ন্যায্য বিচার পাওয়া কঠিন। যেখানে যারা অত্যাচারের শিকার হচ্ছেন অথচ তাদের রক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই, সেই রকম একটা পরিস্থিতি বজায় রেখে সাধারণ মানুষের পক্ষে আইনগত অধিকার আদায় করা সম্ভব নয়।

বুধবার : সারাদেশে পুলিশকে সরকার দলীয় বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহারের এই প্রবণতার পরিণতি কি?

আদিলুর রহমান খান : এই প্রবণতা তো আজকে শুরু হয়নি। এটা অনেকদিন ধরেই চলছে। বিভিন্ন সরকারই পুলিশ বাহিনীকে দলীয় বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করেছে এবং আজকের সরকারও করছে। এই প্রবণতার পরিণতি হচ্ছে যে, পুলিশ বাহিনীর প্রতি মানুষের অনাস্থা গড়ে উঠেছে এবং মানুষ তাদের নিজেদের নিরাপত্তার জন্য, নিজেদের আত্মসম্মান, আত্মমর্যাদা এবং জান-মাল, সম্পত্তি রক্ষায় নিজেদের একটি প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গড়ে তুলবে। যা হবে এই আইনি কাঠামোর বাইরে একটি বিকল্প ব্যবস্থা। আমরা জাতীয় মুক্তির সংগ্রামের সময় দেখেছি, যখন এই সব প্রশাসন ব্যর্থ হয়ে গিয়েছিল, তখন জনগণ গণপ্রতিরোধ কমিটিগুলো গড়ে তুলে তাদের জান-মাল ও সম্পদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছিল। যদি আজকের পুলিশ জনগণের প্রতি আক্রমণকারী বাহিনীতে পরিণত হয়, তাহলে এই আক্রমণের বিরুদ্ধে জনগণ নিজেদের গণপ্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলবে।

বুধবার : আইন-শৃঙ্খলা এবং জননিরাপত্তা রক্ষা করা পুলিশের কাজ। কিন্তু পুলিশ নিজেই যখন আইন ভঙ্গকারী হিসেবে আবির্ভূত হয় তখন সমাজে তার প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে?

আদিলুর রহমান খান : পুলিশ নিজেই আইন ভঙ্গ করলে সমাজের মধ্যে আইনের শাসন বলতে আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না এবং সমাজের যে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোগুলো আছে সে কাঠামোগুলোও তখন আর মানুষের কাছে আস্থার জায়গায় থাকে না। মানুষ তখন স্বভাবতই বিকল্প চিন্তা করতে থাকে এই কাঠামোগুলোকে পরিবর্তন করে জনগনের আস্থাভাজন কাঠামো গড়ে তোলার জন্য। মানবাধিকার কর্মী হিসেবে আমাদের আকাঙ্ক্ষা, রাষ্ট্রযন্ত্র এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের এখন যারা নিয়ন্ত্রণকারী তারা দেশকে ওই যায়গায় ঠেলে দেবেন না। যদি দেনই তাহলে এর বিকল্প কাঠামোও গড়ে উঠবে। ইতিহাস কোথাও থেমে থাকে না।

বুধবার : বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিকে কিভাবে মূল্যায়ন করছেন?

আদিলুর রহমান খান : বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি আজকে একটি কঠিন সময় অতিক্রম করছে। মনে রাখতে হবে বাংলাদেশ কিন্তু ‘কনভেনশন এগেনেস্ট টর্চার’ স্বাক্ষর করেছে। বাংলাদেশ যদি জাতীয় অঙ্গনে অপরাধীদের শাস্তি দিতে ব্যর্থ হয়, তাহলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জবাবদিহিতার সম্মুখীন হতে হবে। বাংলাদেশ দ্বিতীয়বারের মতো জাতিসংঘের হিউম্যান রাইটস কাউন্সিলে নির্বাচিত হয়েছে কিছু অঙ্গীকারের ভিত্তিতে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কিন্তু এই অঙ্গীকারের জবাবদিহিতা করতে হবে। আমাদের দেশে বারবার যারা ক্ষমতায় এসেছেন, তারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছেন বলেই আজকের পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এর বিরুদ্ধে, যেটা আগেই বলেছি যে, জনগণের সচেতনতা, জনগণের সংগঠিত হওয়া এবং জনগণের সম্মিলিত প্রতিরোধের মধ্য দিয়েই আমাদের দেশের মানবাধিকারের পরিস্থিতির উন্নয়ন সম্ভব।

বুধবার : আপনাকে ধন্যবাদ।

বুধবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১১

কয়েক মাসে বিভিন্ন মন্ত্রীর বক্তব্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, তারা জনগণের সঙ্গে অবজ্ঞাপূর্ণ আচরণ করছেন : খনদকার নিয়াজ রহমান

খনদকার নিয়াজ রহমান, নগর পরিকল্পনাবিদ। বিশ্বব্যাংকের তত্ত্বাবধানে ঢাকা আরবান ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থাপনা ও স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্লানের পরিকল্পনাবিদ হিসেবে কাজ করেছেন। দেশের সড়ক-মহাসড়কের বেহাল অবস্থা, বিপর্যস্ত গণপরিবহন, ঢাকার যানজট এবং নগর পরিকল্পনা নিয়ে তিনি তার মতামত তুলে ধরেছেন সাপ্তাহিক বুধবারের কাছে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বুধবারের নিজস্ব প্রতিবেদক মঈনুল হক

বুধবার : বর্তমান সময়ে সারাদেশের সড়ক এবং মহাসড়কগুলোতে বেহাল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এতে যাত্রী ভোগান্তি চরম আকার ধারণ করেছে। সরকার সড়ক নির্মাণ এবং নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করবে এটাই নিয়ম। তাহলে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো কেন?
খন্দকার নিয়াজ রহমান : এই প্রশ্নের উত্তর আমি দুটো অংশে দেব। প্রথমে কিছু নৈতিক প্রশ্ন তুলব। সবক্ষেত্রে শুধু টেকনিক্যাল দিকগুলো তুলে ধরায় রাষ্ট্র পরিচালনার যে নৈতিক দিক তা উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে। নৈতিক দিকটির গুরুত্ব কমে যাওয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোতে বিপর্যয় দেখা দিচ্ছে। সংবিধান অনুযায়ী জনগণ সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। তাদের চাওয়াই রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন। কিন্তু আমাদের মন্ত্রী ও আমলারা বোঝাতে চান যে, জনগণের চাওয়া আইনের মধ্যে না পড়ায় পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। তারা ভুলে যান যে, জনগণ মালিক। মন্ত্রী এবং আমলা জনগণের কর্মচারী। কয়েক মাসে বিভিন্ন মন্ত্রীর বক্তব্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, তারা জনগণের সঙ্গে অবজ্ঞাপূর্ণ আচরণ করছেন। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে আমরা দেখছি, ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কসহ দেশের বিভিন্ন সড়ক চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। কয়েকটি এলাকার সঙ্গে রাজধানীর সড়ক যোগাযোগ বন্ধও হয়ে গেছে। এ বিষয়ে যোগাযোগমন্ত্রী জানালেন অর্থ বরাদ্দ না থাকায় এ অবস্থা হয়েছে। কিন্তু বাজেট এবং অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে, যথেষ্ট টাকা দেওয়ার পরও কোনো কাজ হয়নি। আড়াই বছর ধরে যোগাযোগমন্ত্রী মেগা প্রজেক্ট নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। যার মধ্যে রয়েছে পদ্মাসেতু ও ঢাকা এক্সপ্রেসওয়ে। পদ্মাসেতু দেশের জন্য খুবই জরুরি। কিন্তু এখুনি এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের কোনো সুপারিশ বিশেষজ্ঞমহল থেকে না থাকলেও যোগাযোগ বিভাগ সেটা নিয়ে অনেক বেশি ব্যস্ত। এই প্রকল্পটি ৮/৯ হাজার কোটি টাকার। ফলে এই খাত থেকে যে লাভ আসবে তা সড়কের ছোটখাট রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত কাজের চেয়ে অনেক বেশি। এ কারণেই মন্ত্রী ও আমলারা মেগা প্রজেক্ট বাদ দিয়ে জনগণের প্রয়োজনীয় সড়ক সংস্কারে মনোনিবেশ করেননি বলে আমি মনে করি।
বুধবার : তিন অর্থবছরে সড়কখাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১৯ হাজার কোটি টাকার বেশি। এত পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ থাকা সত্ত্বেও কেন সড়কপথের এমন বেহালদশা?
নিয়াজ রহমান : এর প্রথম কারণ হলো ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতা। ব্যবস্থাপনার প্রথম ধাপ হলো নেতৃত্ব। এক্ষেত্রে যোগাযোগমন্ত্রী সারাবছর যেদিকে ব্যস্ত থেকেছেন তার মন্ত্রণালয়ের আমলারাও সেই দিকটাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। বিশেষ করে সড়কে যে ফোরলেন প্রজেক্ট তা মূলত ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটে বাস্তবায়িত হবে। কাজও ইতোমধ্যে অফিশিয়ালি শুরু হয়েছে। এর ফলে সড়ক সংশ্লিষ্টরা মনেই করেছিলেন লেনের টাকায় মেরামতের কাজও হয়ে যাবে। সেই অপেক্ষায় এতদিন ধরে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বরাদ্দকৃত টাকার বেশিরভাগই বেহাত করা হয়েছে বলে আমার ধারণা।
বুধবার : বলা হয়ে থাকে সড়ক-মহাসড়কের বেহালদশার জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও প্রকৌশলীদের দায়িত্বহীনতা এবং দুর্নীতি দায়ী। এ বিষয়ে আপনি কি মনে করেন?
নিয়াজ রহমান : সরকারের রুলস অব বিজিনেসে একসময় মন্ত্রণালয়ের সর্বময় ক্ষমতা ছিল সচিবের হাতে। কিন্তু পরবর্তীতে মন্ত্রীকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ভালো-মন্দের দায় মন্ত্রীর ঘাড়েই পড়বে। মন্ত্রী বলতে পারেন না যে, তার সচিব বা প্রধান প্রকৌশলী দায়ী। তাদের দোষ থাকতে পারে। কিন্তু দায়িত্ব অবশ্যই মন্ত্রীকে নিতে হবে। দায়িত্ব আমলাদের ঘাড়ে চাপালেই সরকারের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না।
বুধবার : সড়ক খাতের দুর্নীতির বিষয় নিয়ে এখন অনেক আলোচনা হচ্ছে। একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিষয়টি আপনি কিভাবে দেখেন?
নিয়াজ রহমান : দুর্নীতির বিষয়টি শুধু সড়ক খাতে নয় এটিকে সামগ্রিকভাবে দেখতে হবে। এই দেশটার মালিক যে জনগণ এই বোধটি আজকে আমাদের মন্ত্রী এবং আমলাদের মন থেকে মুছে গেছে। যার ফলে সড়কে মৃত্যু যখন গণহত্যার পর্যায়ে পৌঁছে গেছে তখন টাকা বরাদ্দ হয়েছে কি হয়নি তা নিয়ে তর্ক করতে তাদের বাধছে না। সৃষ্ট পরিস্থিতিতে তারা কোনো লজ্জাবোধ করছে না এবং অপরাধবোধে ভুগছে না।
বুধবার : সড়ক-মহাসড়কের অবস্থা নিয়ে দেশব্যাপী সমালোচনার ঝড় ওঠার পর এখন তাড়াহুড়া করে সংস্কার কাজ করা হচ্ছে। এতে মূল সমস্যার কতটা সমাধান সম্ভব?
নিয়াজ রহমান : আমরা দেখেছি মহাসড়কগুলো পানির নিচে ডুবে আছে। এই পানিতে এখন পাথর, বালু ফেলতে হবে। তারপর এর মধ্যে বিটুমিন দিতে হবে। স্বাভাবিকভাবেই এই কাজে গুণগত মান অর্জন করা সম্ভব হবে না। ফলে যে ইঞ্জিনিয়ার এবং কনট্রাক্টর এই কাজ করছে খুব শিগগিরই কাজটি তারা আবার পাবে। আর সবচেয়ে বড় কথা সড়কে যে সংকটকালীন অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে তা ইচ্ছা করে তৈরি করা হয়েছে। জরুরি পরিস্থিতিতে জরুরিভিত্তিতে কাজ করার মধ্য দিয়ে দুর্নীতির সুযোগ বেশি থাকে।
বুধবার : সম্প্রতি সড়ক দুর্ঘটনায় একজন বিশিষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং একটি টেলিভিশনের প্রধান নির্বাহী থেকে শুরু করে চট্টগ্রামের ৪২ ছাত্রের মৃত্যুসহ অসংখ্য মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। সড়কপথে দুর্ঘটনা বৃদ্ধির কারণ কি বলে আপনি মনে করেন?
নিয়াজ রহমান : সড়কে দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হচ্ছে, রাষ্ট্রের এই বিষয়ে মোটেও নজরদারি নেই। একটা মহাসড়কের নেটওয়ার্ক তৈরি করার পরে তার ব্যবস্থাপনা খুবই জরুরি। যে বড় বড় রাস্তা তৈরি হচ্ছে তার কিন্তু কিছু নিয়ম-কানুন আছে। ডিজাইন করার সময় ঠিক করা হয় সড়কে কি গতিতে গাড়ি চলবে, কোন কোন যায়গায় ওভারটেক করা যাবে, কোন কোন যায়গায় মানুষ রাস্তা পার হতে পারবে ইত্যাদি বিষয়। পরবর্তীতে সম্পূর্ণ অবহেলার সঙ্গে এই নিয়মগুলো ভঙ্গ করা হয়। রাস্তায় আইন মেনে চলার জন্য ৪০ বছরে কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। হাইওয়ে পুলিশ বলে যারা আছে তারা কি দায়িত্ব পালন করে তা মানুষের জানা নেই। এই অবস্থায় আমাদের যোগাযোগ মন্ত্রণালয় হাইওয়েগুলোতে এক ধরনের গণহত্যার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার হিসাবে দেখা গেছে, ৫ বছরে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ৬০ হাজার থেকে এক লাখ লোক মারা গেছেন। কোনো সভ্য দেশে মৃত্যুর পরিসংখ্যান এমন হতে পারে না। যেসব দেশে যুদ্ধ হচ্ছে সেসব দেশেই কেবল এই ধরনের পরিসংখ্যান পাওয়া যায়।
বুধবার : সরকারের একজন মন্ত্রীর চাপে কোনো পরীক্ষা ছাড়াই চালকদের পেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। ড্রাইভিং লাইসেন্সের ক্ষেত্রে এই রাজনৈতিক চাপকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করেন?
নিয়াজ রহমান : আমি রাজনৈতিক চাপের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে যে প্রশ্নটি তুলতে চাই তা হলো, রাষ্ট্র একটি আইন দিয়ে পরিচালিত হতে হবে। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে যারা থাকবেন তাদের প্রথম কাজ হচ্ছে আইন-কানুন প্রয়োগ হচ্ছে কিনা এবং মানুষ মেনে চলছে কিনা তা দেখা। এক্ষেত্রে একজন মন্ত্রী নিজে কিভাবে প্রচলিত আইন ভেঙে লাইসেন্স দিতে বলেন? আরো বিস্ময়কর ব্যপার হচ্ছে, গণমাধ্যম যখন বিষয়টি নিয়ে আইনের কথা বলছে মন্ত্রী তখন ঔদ্ধত্যপূর্ণভাবে আইন লঙ্ঘনের পক্ষে বক্তব্য দিচ্ছেন। সরকারে যারা আছেন তারা যদি আইন ভঙ্গ করতে এত বেশি উৎসাহী হন, তাহলে সাধারণ মানুষ কোথায় যাবে? আর তাছাড়া নৌমন্ত্রীর মর্জি মাফিক যদি ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়া হয় তাহলে সড়ক-মহাসড়কে গণহত্যা আরো বাড়বে এটা নিশ্চিত।
বুধবার : ঢাকায় যানজট নিরসনে সিসিটিভি ক্যামেরা, লেনপ্রথাসহ নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল। এখন আবার দড়ি টানিয়ে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কেন ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।
নিয়াজ রহমান : ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করা না যাওয়ার কারণটা খুবই সাধারণ। ঢাকায় এখন স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্লান তৈরি করা হচ্ছে। এর আগে ১৯৯৮-৯৯ সালে ঢাকা আরবান ট্রান্সপোর্ট প্লান করা হয়েছে। এই প্লানগুলো তৈরির পর জাতীয় সংসদে পাস হয়। ফলে এগুলো কিন্তু আইন। এখন এই আইন প্রয়োগ করা এবং মেনে চলা পুলিশের দায়িত্ব। কিন্তু আমরা দেখছি এই আইন পুলিশসহ অনেকেই লঙ্ঘন করছে। তাহলে একটি আইন তৈরি করে যদি তা ভাঙার জন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় তাহলে সমস্যা থেকে উত্তোরণ কখনোই সম্ভব হবে না। এখন ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থা ঠিক রাখতে হলে শেষ যে পরিকল্পনা তৈরি হয়েছে তা ‘স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্লান’। এই প্লানের সুপারিশ অনুযায়ী প্রচুর পরিমাণে ফুটপাত তৈরি করা এবং বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট প্রকল্প কার্যকর করা জরুরি। স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্লানের প্রথম ফেসের সুপারিশ হওয়া সত্ত্বেও বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট কার্যকরে গড়িমসি করা হচ্ছে। এর কারণ বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট হয়ে গেলে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের আগ্রহের প্রজেক্ট ‘এক্সপ্রেসওয়ে’ প্রকল্পের যৌক্তিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। তাই এক্সপ্রেসওয়ের কাজ শুরুর আগে হয়তো বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট হবে না। অথচ এক্সপ্রেসওয়ের বিষয়টি কিন্তু স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্লানের দ্বিতীয় পর্যায়ের শেষের দিকে উল্লেখ করা হয়েছে এবং এর সম্ভাব্যতা যাচাই করার কথা বলা হয়েছে।
বুধবার : সরকারি দলের কয়েকজন এমপিসহ সমাজের নানান অংশ ব্যর্থতার দায় নিয়ে যোগাযোগ ও অর্থমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করছেন। আপনার মতামত কি?
নিয়াজ রহমান : পদত্যাগের দাবির সঙ্গে আমি একমত। বিশেষ করে যোগাযোগমন্ত্রীর পদত্যাগের যে দাবি উঠেছে তা আমি শতভাগ সমর্থন করি। কিন্তু বাংলাদেশের সব সরকারের ক্ষেত্রেই যে মন্ত্রীর বিরুদ্ধেই ব্যর্থতার অভিযোগ উঠুক না কেন পদত্যাগের নজির নেই। কারণ তাদের মধ্যে যে জিনিসটা সবচেয়ে কম আছে সেটা হলো লজ্জা। তারা যদি ভাবতেন তাদের বেতন-ভাতা ও গাড়ি-বাড়ির একটা অংশ একজন রিকশাচালক, একজন দিনমজুরের কাছ থেকে আসে তা হলে কখনোই দেশে এই অবস্থার সৃষ্টি হতো না।
বুধবার : সার্বিক যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নের অন্তরায় কি এবং কিভাবে এর সমাধান সম্ভব বলে মনে করেন?
নিয়াজ রহমান : প্রধান অন্তরায় হচ্ছে আমাদের ব্যবসায়িক মহল। তাদের দাবি এবং চাপের কাছে সমগ্র জনগণের স্বার্থ বিসর্জন দেওয়া হচ্ছে। ঢাকায় মাত্র দুই শতাংশ মানুষের কাছে ব্যক্তিগত গাড়ি আছে। কিন্তু এই গাড়ির চলাচল ও নিয়ন্ত্রণে সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই। ব্যক্তি বা গোষ্ঠীগত স্বার্থের বাইরে গণপরিবহন ব্যবস্থার দিকে নজর দিতে হবে। যোগাযোগের ক্ষেত্রে শুধু সড়ক নয়। দক্ষ আরেকটি ব্যবস্থা হচ্ছে রেল। কিন্তু রেল সরকারি। ব্যবসায়ীদের মুনাফা এখানে অনেক কম। আর এ কারণেই এই খাতে সরকারের কোনো আগ্রহ নেই। দুই শতাংশ মানুষের ব্যক্তিগত গাড়িকে গুরুত্ব না দিয়ে যদি ৯৮ শতাংশ মানুষের গণপরিবহন ব্যবস্থার দিকে নজর দেওয়া হতো তা হলে যোগাযোগ ব্যবস্থা এমনভাবে ভেঙে পড়ত না। সারাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য মহাসড়কে লেন করতে হবে। বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট চালু করতে হবে, ব্যক্তিগত গাড়ি আমদানি নিরুৎসাহিত করতে হবে এবং সড়কের পাশাপাশি রেলের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। রাজধানীর পরিবহন ব্যবস্থার কথা যদি ধরা হয় তাহলে বলব, কোনো প্রকার নিয়মনীতি ছাড়াই ৫০ লাখ লোকের রুটিরুজির রিকশাকে রাস্তা থেকে জোর করে তুলে দেওয়া হচ্ছে। অবস্থাটা দাঁড়িয়েছে এমন যে, পুলিশের প্রধান বা মন্ত্রীর ইচ্ছা হলেই বিপুলসংখ্যক মানুষের পেটে লাথি মারা যায়। এখন আমি জনগণকে আহবান জানাব তারা যেন একটি দাবি তোলেন যে, সপ্তাহে অন্তত একদিন ব্যক্তিগত গাড়ি রাস্তায় বের করা বন্ধ রাখতে হবে। এটা যদি করা যায় তাহলে এক মাসের চার দিনে মানুষের কাছে স্পষ্ট হয়ে যাবে ট্রাফিক ব্যবস্থার সমস্যা কোথায়। মানুষ জেনে যাবে ঢাকায় মাত্র দুই শতাংশ মানুষের জন্য ৯৮ শতাংশ মানুষের জীবন ওষ্ঠাগত।
বুধবার : আপনাকে ধন্যবাদ।

মঙ্গলবার, ২৩ আগস্ট, ২০১১

আদালতে গেলে শোনা যায় আওয়ামী লীগ বেঞ্চ, বিএনপি বেঞ্চ, জামায়াত বেঞ্চ। এগুলো কি শুনতে ভালো লাগে! এভাবেই আমাদের বিচার বিভাগ চলছে : ব্যারিস্টার রফিক-উল হক

সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক। উচ্চআদালতে চলমান অস্থির অবস্থা, বিচার বিভাগের ওপর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, দলীয় বিবেচনায় বিচার বিভাগে নিয়োগসহ আদালত প্রাঙ্গণের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন সাপ্তাহিক বুধবার-এর সঙ্গে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন – আহম্মদ ফয়েজ
বুধবার : মঙ্গলবার উচ্চতর আদালতে বিএনপি সমর্থিত আইনজীবীদের নেতৃত্বে একটি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে মামলা ও গ্রেফতারের ঘটনা ঘটেছে এবং আদালত প্রাঙ্গণ অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। উচ্চতর আদালতে এ ধরনের ঘটনার পেছনে কি কারণ থাকতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
ব্যারিস্টার রফিক-উল হক : আদালতে ঘটে যাওয়া এই ঘটনার প্রধান কারণ, আমার কাছে মনে হয়েছে, আইনজীবী এবং আদালত দুইয়েরই ধৈর্যের অভাব। তাদের ধৈর্য না থাকায় এই ছোটখাটো বিষয় থেকে এমন ঘটনার জন্ম হচ্ছে। এখানে একটা বিষয় হচ্ছে আইনজীবীদের মধ্যে যেমন দলীয় রাজনীতি রয়েছে, তেমনি আমার ধারণা, কিছু আদালতও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে। আদালত যদি নিরপেক্ষ না থাকে, তাহলে আইনজীবীরাও নিরপেক্ষ এবং শান্ত থাকতে পারেন না। আইনজীবীরা উত্তেজিত হয়ে যান। এই পরিস্থিতির জন্য আইনজীবীরা যেমন দায়ী, তেমনি কিছু আদালতও দায়ী। আদালত যদি ইন্ধন না যোগাত তাহলে আইনজীবীরাও এরকম আচরণ করতে পারত না। ওই ঘটনায় আদালত যেসব মন্তব্য করেছে, সেগুলো ইস্যুর বাইরে ছিল। সেদিন আমিনী ইস্যু ছিল কিন্তু অন্য কেউ তো ইস্যু ছিল না। যারা ইস্যু নয়, তাদের সম্পর্কে অপ্রয়োজনীয় মন্তব্য করার কি দরকার! এই মন্তব্য যারা মেনে নিতে পারেননি, তাদের ধৈর্য ধারণ করা উচিত ছিল, কিন্তু তারা উত্তেজিত হয়ে গেছেন। আদালত যদি মন্তব্যের পর কোনো অর্ডার দিত তাহলে ওই আইনজীবীরা আপিল বিভাগে যেতে পারতেন। আইনি প্রক্রিয়ায় থেকেই এগুনো সম্ভব হতো, কিন্তু সেটা না করে, আদালতে মারমুখী হওয়াটা তো উচিত হয়নি। এ ধরনের ঘটনা কারো জন্যই সুখকর নয়। বিচারকদের জন্যও নয়, আইনজীবীদের জন্যও নয়। যারা সংশ্লিষ্ট নয় তাদের সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করা আদালতের জন্য উচিত নয়। আর যে কোনো ঘটনাতেই আইনি প্রক্রিয়ায় এগুনোই আইনজীবীদের কাজ হওয়া উচিত। আমি ব্যক্তিগতভাবে এসব ঘটনা খুবই অপছন্দ করি। আদালতে মারামারি, যুদ্ধংদেহীভাব কখনোই ভালো নয়। এগুলো কারো কাছেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। গণতন্ত্রের জন্য লড়াই হতে পারে, মানবিকতার জন্য লড়াই হতে পারে। কিন্তু যা ঘটল তা কেন হবে!
বুধবার : ২০০৬ সালে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ সমর্থিত আইনজীবীরা প্রধান বিচারপতির কার্যালয় ভাংচুর করেছে। এছাড়া বিভিন্ন সময় আদালত প্রাঙ্গণে সমাবেশ ঘটিয়ে আদালতকে হুমকি প্রদানের ঘটনাসহ এমন বেশ কিছু ঘটনা ঘটে। ২০০৬ সালের ঘটনায় জড়িতরা পরবর্তীতে এই আদালতেরই বিচারকও হয়েছেন এবং রাষ্ট্রের আইন কর্মকর্তার পদেও নিয়োগ পেয়েছেন। এই প্রবণতাকে আপনি কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
রফিক-উল হক : সেই সময় যারা গোলমালের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে তাদের কাউকেই চিনি না। যারা এখন বিচারক হয়েছেন, কি ছিলেন তারা, কোন পার্টি করতেন, এসবের কিছুই আমি জানি না। তবে এই প্রবণতাটা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে এর চাইতে খারাপ কিছুই হতে পারে না। এটা ভয়ঙ্কর এক প্রবণতা। আমি খুবই সচেতনভাবে এই বিষয়টিকে অপছন্দ করি। এই ধরনের ঘটনার সঙ্গে কখনোই একমত পোষণ করা যায় না। একজন বিচারক নিয়েগের ক্ষেত্রে অবশ্যই এই আস্থাটা থাকা জরুরি, যার ফলে একজন বিচারকের রায় মেনে নিতে কোনো মানুষের দ্বিধা কাজ করবে না। কিন্তু যা হয়েছে এমন ঘটনা আইনি কাঠামো, স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা এবং গণতন্ত্রকে ক্ষুণ্ণ করবে। এসব করা হলেই এই সিস্টেমগুলো ভেঙে পড়বে। এভাবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা যায় না, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। বিচারকরা আইনানুগতভাবে যা ইচ্ছে তাই করবেন, আইনজীবীরাও আইনানুগভাবে যা ইচ্ছে তাই করবেন, কিন্তু কিসের জন্য এসব করা হবে এমন কোনো লক্ষ্য স্থির না থাকলে সব কিছুতেই ঝামেলা হয়ে যাবে।
বুধবার : দলীয় বিবেচনায় ও জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের মাধ্যমে বিচারকসহ বিভিন্ন পদে নিয়োগের নেতিবাচক প্রভাব কি হতে পারে বলে আপনার কাছে মনে হয়?
রফিক-উল হক : যেসব ঘটনা এখন ঘটছে, এগুলোই তো নেতিবাচক প্রভাব। দলীয় নিয়োগের ফলেই তো এসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে। বিচারক যদি নিরপেক্ষ হতো তাহলে নিশ্চই এই ধরনের ঘটনা ঘটতো না। আমার সবচেয়ে খারাপ লাগে, যখন দেখি, কিছু আইনজীবী সরাসরি রাজনীতি তো করেই, কিছু আইনজীবী আছে রাজনীতি করেন না কিন্তু রাজনীতির জন্য পরিচালিত হন গোপনে। এখন বিষয় হচ্ছে স্বাধীন বিচার ব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠিত করা তো শুধু আইনজীবীদের দায়িত্ব নয়, এটা বিচারকদেরও দায়িত্ব। দেখা যাচ্ছে জামিনের জন্য যাওয়ার পর, আদালত যে আগুনে পানি ঢালবে সেখানে তেল ঢালছে। বিচারকরা এটাকে অনেক বড় ক্রেডিট হিসেবে দেখছেন। অন্য যায়গায় বাহ বাহ পাবেন। কিন্তু এটাতো ভালো নয়। বিচারক এবং আইনজীবী দু’জনই বিচার ব্যবস্থার অংশ। আইনের সুশাসন প্রতিষ্ঠার স্বার্থে এখানে দু’জনেরই কর্তব্য রয়েছে। এর মধ্যে একে অপরের সহযোগিতায় না এগুলে চলবে কি করে! আমি আইনজীবী যদি ভুল করি আপনি বিচারক সে ভুলে আগুন দেবেন না। এজন্যই রাজনৈতিক নিয়োগের মাধ্যমে এবং রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট বিচারককে নিয়োগ দেওয়া ঠিক না। এখানে এমন লোক নেওয়া দরকার, যারা কখনোই দলীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন। এই ধরনের লোক পাওয়া অবশ্য কঠিন, কিন্তু সর্বোচ্চ চেষ্টাটুকু তো থাকা লাগবে। খারাপের মধ্যে হলেও ভালো খুঁজে বের করতে হবে।
বুধবার : প্রচলিত ধরনের নিয়োগের পেছনে রাজনৈতিক অভিপ্রায় কতটুকু বলে আপনি মনে করেন?
রফিক-উল হক : দেখা যায় সরকার নিজেদের সুবিধার কথা চিন্তা করে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দিচ্ছে। এবারো তাই ঘটলো, জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে একজনকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হলো। যে বিচারকের জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করা হলো তিনি ব্রিগেডিয়ার (অবঃ) হান্নান শাহের ভাই। তাকে নিয়োগ দিলে আবার কি হয় এই চিন্তা থেকেই তাকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এখন বলছে অন্য কথা। সে নাকি অসুস্থ। আরে কিসের অসুস্থ? আমি তার চেয়ে অনেক বেশি অসুস্থ। আমি কাজ করছি না? এখন এসব অজুহাত দিয়ে দেশটার বারোটা বাজিয়ে তো কোনো লাভ নেই। আসলে এই বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে দলীয় রাজনৈতিক অভিপ্রায় কাজ করছে। এটা খুব খারাপ প্রবণতা। বিচারপতি যিনি হবেন সেখানে কার ছেলে, কার ভাই, কার আত্মীয় এসব বাদ দিয়ে কোয়ালিটি দেখতে হবে। তিনি মানুষ হিসেবে সৎ কিনা, কাজের জন্য যোগ্য কিনা, এসব বিষয় অগ্রাধিকার দিতে হবে। তা না করে যার যেভাবে সুবিধা হচ্ছে সেভাবে যদি করে সেটা কিন্তু ঠিক নয়।
বুধবার : রাষ্ট্রের তিনটি স্তম্ভের একটি হচ্ছে বিচার বিভাগ। এই বিভাগের বর্তমান অবস্থাকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
রফিক-উল হক : আমরা তো বলেই চলেছি স্বাধীন বিচার বিভাগ চাই। সরকারও জানে, এই নিয়ে কত কি হলো। ২০০৭ সালের নভেম্বর থেকে স্বাধীন বিচার বিভাগ করা হলো। তখন ঢোল পিটিয়ে এসব প্রচারও করেছে। কিন্তু এগুলো তো মুখের কথা। আসলে স্বাধীন বিচার বিভাগ নির্ভর করে যিনি বিচারক তিনি কতটুকু নিজের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করতে পারেন তার ওপর। উচ্চ আদালতের কোনো বিচারকের তো চাকরি যাওয়ার সুযোগ নেই। তাহলে কেন তিনি স্বাধীন হবেন না। পিছনের লোকগুলোকে খুশি করার জন্যই তিনি স্বাধীন থাকেন না। আরেকটা হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হওয়ারও একটা লোভ কাজ করতে পারে। যে বিচারক শেষ অবসরে থাকবেন, তিনিই হবেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। এই বিষয়টা বিচার বিভাগের জন্য যে কত বড় ক্ষতিকর সেটা বোঝাটাও বেশ কঠিন। এই ব্যবস্থাটি না থাকলে ওয়ান-ইলেভেনও হতো না।
বুধবার : সাম্প্রতিককালে আদালতের কিছু রায় নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক শুরু হয়েছে। এই বিতর্কের কারণ কি? আদালতের এই রায়গুলো কতটা যথাযথ ছিল?
রফিক-উল হক : রাজনৈতিক বিতর্কের পিছনে আসলে যৌক্তিক কোনো কারণ নেই। যেসব রায় নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক চলছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে ওইসব রায় ভালো করে রাজনৈতিক দলগুলো দেখেইনি। তারা রাজনৈতিক কারণেই রাজনৈতিক বিতর্কের দিকে যাচ্ছে। আর রায়ের যৌক্তিকতা কিংবা যুক্তিহীনতার বিষয়ে কিছু বলার নেই সেভাবে। আদালতের তো যেটা মন চাচ্ছে সেটাতেই একটা অর্ডার দিয়ে বসছে। এগুলো এক ধরনের অপ্রয়োজনীয় কাজ। রায় যখন হয়, বিচারক যখন কথা বলেন, সেগুলোই আইন। কিন্তু এই আইন চিরকাল থাকে না। এগুলো সময়ের প্রেক্ষাপটে, রাজনীতির প্রেক্ষাপটে এবং বৈশ্বিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে পাল্টে যায়। আমাদের বিচারকরা এখন আইনের বিচার না করে দেখে মানুষটা কে, সময়টা কি। এসব কারণে সব বিষয় খুব বেশি সাংঘর্ষিক হয়ে যায়। এগুলো মেনে নেওয়া যায় না। এসবের মাধ্যমে দেশটাকে একটা অস্থির পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। আমরা এমনটি মোটেও আশা করিনি। সুপ্রিমকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন এর বিরোধিতা করছে। আরো অনেকেই করেছে। আমি নিজেও এই ধরনের কর্মকান্ডের বিরোধী।
বুধবার : অনেক আইনজীবী অভিযোগ করেন, আদালতের এই বেঞ্চ এই দলের, ওই বেঞ্চ ওই দলের। এই অভিযোগগুলো কেন আসে?
রফিক-উল হক : এই প্রবণতাটা গত কয়েক বছর ধরে চলে আসছে। আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে বেঞ্চগুলো অঘোষিতভাবেই আলাদা হয়ে গেছে। আদালতে গেলে শোনা যায় আওয়ামী লীগ বেঞ্চ, বিএনপি বেঞ্চ, জামায়াত বেঞ্চ। এগুলো কি শুনতে ভালো লাগে! এভাবেই আমাদের বিচার বিভাগ চলছে। এর চাইতে দুঃখের আর কিছু নেই। এভাবে তো আর চলতে পারে না, একদিন না একদিন এ অবস্থার উন্নতি হবে। মানুষ আর কত নিচে নামবে! নামতে নামতে আমরা অনেক নিচে নেমেছি, এবার ওঠা ছাড়া উপায় নেই।
বুধবার : সম্প্রতি আদালতের একটি সংক্ষিপ্ত রায়ের ওপর ভিত্তি করে সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেছে। আদালতের সংক্ষিপ্ত এই রায়ে দুটি দিক থাকলেও সরকার গ্রহণ করেছে একটি। এর কারণ কি হতে পারে, আর আদালতের রায়টি এখনো পূর্ণাঙ্গ না আসারই বা কি কারণ থাকতে পারে?
রফিক-উল হক : এই রায়টি না দেখেই সরকার একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। আদালতের যে সংক্ষিপ্ত রায় সেখানে বলা আছে পূর্ণাঙ্গ রায় ফলো করার জন্য। কিন্তু এখন যে কাজটি হয়ে গেল সেটি কিসের ওপর ফলো করে হয়েছে। ওই সংক্ষিপ্ত রায়টিও তো পুরোপুরি মানা হয়নি। এই কাজটি প্রধানমন্ত্রীর করা উচিত হয়নি। তার কাছ থেকে আমরা এসব আশা করি না। তিনি তো ‘বঙ্গবন্ধু’ কন্যা। তার রক্তে রাজনীতি। তিনি কি করে এমন একটা কাজ করে বসলেন। যেখানে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ছাড়া কোনোভাবেই চলা সম্ভব না, সেখানে তিনি পুরো ব্যবস্থাটাকেই আদালতের দোহাই দিয়ে বাতিল করে দিলেন।
আদালত এমন একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে যে সংক্ষিপ্ত রায় দিয়ে বসে আছে এটাও ঠিক হচ্ছে না। এই রায়টি কেন এখনো পূর্ণাঙ্গভাবে এলো না – তা আমার কাছে বোধগম্য নয়।
বুধবার : বিচার বিভাগের ওপর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে?
রফিক-উল হক : বিচার বিভাগের ওপর রাজনৈতি প্রভাব যদি অব্যাহত থাকে তাহলে বিচার বিভাগ চূড়ান্তভাবে ভেঙে পড়বে। বিচার বিভাগ রাষ্ট্রের একটা অঙ্গ, এই অঙ্গটি হচ্ছে মাথা। মাথাই যদি ভেঙে পড়ে তাহলে আর কিছুই রইলো না। এটা নিয়ে যেন কারোরই কোনো মাথা ব্যথা নেই। কিন্তু বিষয় হচ্ছে এই দেশটাকে তো আমাদেরই রক্ষা করতে হবে। কেউ এসে তো এই কাজ করে দিয়ে যাবে না।
বুধবার : বিসমিল্লাহ, রাষ্ট্রধর্ম, ধর্মীয় রাজনৈতিক দল রেখেই সরকার সংবিধান সংশোধন চূড়ান্ত করেছে। এই বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখেন?
রফিক-উল হক : এখানে কথা হচ্ছে রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম হয়? রাষ্ট্র কি নামাজ পড়ে, রোজা করে, নাকি পূজা করে? রাষ্ট্রের ধর্ম হবে কেন? রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম হয় না। ধর্ম হয় মানুষের। এটা এরশাদের আমলে হয়েছে। এরশাদ রাজনৈতিক সুবিধা হাসিলের জন্যই এ কাজ করেছিলেন। তিনি মনে করেছিলেন, আকর্ষণীয় কিছু করতে হবে, সেজন্যই হয়তো করেছেন। সে সময় কি করেছিল এরশাদ তা কেউ চিন্তাই করতে পারবে না। আমি নিজে ছুটে গিয়েছিলাম তার কাছে। তাকে বললাম রাষ্ট্রের ধর্ম কিভাবে হয়? এখানে তো মুসলমান ছাড়াও অন্যান্য জাতি-ধর্মের লোকেরা বসবাস করে। তখন তিনি এর সঙ্গে যোগ করেছেন তবে অন্যান্য ধর্মের লোকেরাও নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে। এবারো শেখ হাসিনা সেই অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে পারেননি।
বুধবার : আপনাকে ধন্যবাদ।